পাগল করা দিন
কিছু দিন আছে, যাকে বলা যায় পাগল করা দিন। সব কিছুই কেমন যেন উল্টোপাল্টো হয়। গতকাল ২১ নভেম্বর ২০১৬ ছিল তার একটি।
গত সপ্তাহ থেকেই প্ল্যান ছিল কাপুস্তা কভাসিস মানে বাধা কপি নোনতা করার। দোকানেও পাওয়া যায়, তবে আমরা নিজেরাই করি। নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের প্রথমে, যাতে আগামী বসন্ত পর্যন্ত খাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ কেজি। বড় সংসারের সব কিছুই বড় বড়। দুবনায় আমার একার সংসারে এক কেজি চিনি কিনলে মাসের পর মাস চলে যায়, একই কথা অন্য সব কিছুতে। কিন্তু গ্রীষ্মে যখন ছেলে-মেয়েরা বেড়াতে আসে, আমি কেনার আগে সব শেষ হয়ে যায়, মনে হয় সারানচা (এক ধরণের পোকা, যা মুহূর্তে ক্ষেতের ফসল শেষ করে দেয়) পড়লো।
শনিবার জিনিষপত্র, মানে বাধা কপি, গাজর, বিট, রসুন এসব কিনে রাখলাম। ওই দিন আমাদের এক আড্ডা থাকায় কাজটা পিছিয়ে নেয়া হলো রোববার। রোববার আবার আপেল, সেলদেরই (এক ধরণের ধোনে টাইপ সবজি) কিনে আনা হলো। বাধা কপি, গাজর, বিট সব পরিষ্কার করতে করতে বেশ রাত। এছাড়া ক্রিস্টিনাকেও খুব ভোরে উঠতে হবে, সকালে ও একটা চার্চে সঙ্গীত কন্ডাক্ট করবে, তাই ঠিক হলো, সোমবার সকালে উঠে এসব করবো। আমার নিজেরই কিছু কাজ ছিল মস্কোয়, তাই দুবনা রাতে ফিরলেও হবে। তবে আমার প্ল্যান ৭ তার মধ্যে ফেরা যাতে সাঁতার কাটতে আর ছাউনায় বসে থাকতে পারি।
ক্রিস্টিনা উঠলো ৫ টায়, তারপর ওকে সকালের খাবারটা তৈরী করে দিলাম। আমি থাকলে ওরা আমার কাছেই এসব আবদার করে। এর পর গেলো সেভা তার স্কুলে। ওকে বিদায় দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পরে উঠি উঠি ভাবছি এর মধ্যে আইকা, টেরি, টোট্টি, মার্সিক, ভার্দিক, লিসিয়ানা, এওলা আর মিকি - মানে আমাদের কুকুর গুলো আমার লেপের উপর আর নীচ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। একটু বিরক্ত হলেও সকাল বেলার এই ম্যাসাজ কিন্তু আমার খুব ভালোই লাগে। যতক্ষণ না গুলিয়া ওদের সবাইকে এক এক করে আদর করছে, আর সাবাস বলছে, ওদের এই প্যারেড শেষ হয় না।
মনিকার কাজ আজ ২ টা থেকে, তাই ও শুয়েই রইলো, আমরা শুরু করলাম কপি কাটা। এখানেও ছবির মতো, যখন মডেল খুব ক্লান্ত হয়ে পরে, ভালো ছবিগুলো তখনই আসে। আমার কাটাও প্রথম দিকে তেমন ভালো হচ্ছিলো না, কপির টুকরো গুলো ইয়া বড় বড় হয়ে যাচ্ছিলো, তবে শেষের দিকে গুলিয়া বললো, এখন টুকরো গুলো ঠিকঠাক হচ্ছে। যাই হোক বরাবরের মতো কপি, গাজর আর আপেল দিয়ে একটা বড় পাত্র পূর্ণ হলো। পরেরটা হলো কপি, বিট আর সেলদেরই দিয়ে। আর শেষ এক্সপেরিমেন্টালি একটা হলো কপি, বিট, মরিচ আর আদা দিয়ে। সবগুলোতেই কমন থাকে ক্লুকভা, লাল রঙের এক ধরণের বুনো বেরি। এবার এসব করার একটা স্পেশাল আগ্রহ হলো এই প্রথম গুলিয়া বললো সব ঠিকঠাক হলে দিদির জন্য কিছুটা পাঠাবে। ও আমাদের বাড়ীর কথা তেমন জিজ্ঞেস করে না, হঠাৎ কখনো কখনো দিদির কথা জিজ্ঞেস করে। কারণটা মনে হয়, এ দেশে মেয়েরাই সাধারণত মা-বাবার সাথে থেকে যায়, মা-বাবার দেখাশুনা করে, যেমনটা ছেলেরা করে আমাদের দেশে। তাই এখানে ভাইদের থেকে বোনদের খবরটা নেয়ার রেয়াজটাই বেশি। অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়।
কাটাকাটি যখন শেষের পথে গুলিয়া বললো
- আমরা যখন বুড়ো হবে, তুমি কপি কেটে দিও, আমি এসব তৈরী করে বাজারে বিক্রি করবো।
আমি প্রায়ই বলি, যখন চাকরী থেকে রিটায়ার করবো, তখন তো কিছু করার থাকবে না, দেশে চলে যাবো। ও খুব কষ্ট পায় এ কথা শুনে। মনে হলো, তাই আমার জন্য বৃদ্ধ বয়সে চাকরী খুঁজছে। আমি কিছু না বলে বললো
- না হয় কোনো এক বুড়ীকে বলবো আমাদের কপি বিক্রি করতে।
- আমরা যখন বুড়ো হবো, ঐসব বুড়ী তখন আর থাকবে না।
জানি না, অন্যেরা কি ভাবে, তবে আমরা কখোনোই নিজেদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখি না বৃদ্ধ বয়েসে। গ্রীষ্মে যখন ঘুরতে যাই, তখনও কোথাও বসে না থেকে সাগর থেকে পাহাড় পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই, কখনো হেটে, কখনো বাসে বা ট্রেনে করে। ছবি তুলি, পাথর কুড়াই। তাই বসে বসে নাতি-নাতনিদের সাথে খেলা করার চেয়ে কপি কাটার আইডিয়া আমার কাছে অনেক সুখের মনে হয়। এক সময় মনে হতো ছেলে-মেয়েরা ছাড়া আমাদের মধ্যে কমন তেমন বেশি কিছু নেই। আজকাল মনে হয়, যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের পথদুটো যেন ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে।
যাহোক এসব করতে করতে বারোটা বাজলো। তারপর ভাবলাম খেয়েদেয়ে বেরুনো দরকার। ইচ্ছে ছিল ৩-৩০ বা ৪-৩০ এর বসে যাবো। তাতে করে ২ টোর দিকে বেরুলেই চলবে। এর মধ্যে ক্রিস্টিনা ফিরে এলো, মনিকাও বেরিয়ে গেলো। আমি অবশ্য ওদের আর নিজের জন্য দুপুরের খাবারটা তৈরী করে খেয়ে নিলাম এসবের মাঝেই।
আমার বাসা থেকে রাশিয়ান একাডেমী অফ সাইন্সের অফিস খুব দূরে নয়, দেখা যায়, কোনাকুনি হাঁটার পথ থাকলে মনে হয় ২ বা আড়াই কি.মি. তবে যেতে হবে ঘুরে, তাই বাস বা ট্রামে উঠতে হবে। ভাবলাম বাসে করে লেনিনস্কি প্রস্পেক্ট যাই, ওখান থেকে ট্রলিতে চলে যাবো। বাসা থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলাম, কিন্তু একেবারে নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেলো ১১৯ নম্বর বাসটা। কি করা, উঠলাম ২৬ নম্বর ট্রামে, দু স্টপেজ পরে নেমে সেন্ট্রাল সার্কুলার ট্রেন লাইনের ক্রিমস্কায়া থেকে গেলাম গ্যাগারিন স্কয়ারে এক স্টেশন পরে। খুব পরিচিত জায়গা। বেরিয়ে দেখি আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্যাগারিন। একটা ছবি নিয়ে হাটছি সামনে। ওই তো দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান একাডেমী অফ সাইন্সের বিল্ডিংয়ের ঝকঝকে চূড়া। কিন্তু সব কিছু এতো বদলে গেছে যে রাস্তা পাওয়া মুশকিল। যাই হোক, সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট এন্ট্রান্স পেতে লাগলো আরো মিনিট দশেক। শেষ পর্যন্ত এপ্লিকেশনটা বক্সে ফেলে ফিরে এলাম লেনিনস্কি প্রসপেক্ট মেট্রোর সামনে।
তখন ৩ -১৮। ৩-৩০ এর বাস আর পাচ্ছি না। ৪-৩০ পেয়ে যাবো। ভাবলাম যদি মেট্রোতে যাই সাভিওলেভস্কায়া যেতে লাগবে বড়োজোর ২৫ মিনিট, তার মানে প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা। অন্য উপায় - সেন্ট্রাল সার্কুলার ট্রেন লাইনে যাওয়া। যেহেতু সার্কুলার লাইন, দুভাবে যাওয়া যায় - ছোট বা ঘোরা পথে। প্রথমটায় গেলে লাগবে ৩০ মিনিট - আবার সেই অপেক্ষা। ঘোরা রাস্তায় গেলে আমি কাটায় কাটায় ৪-৩০ এ পৌঁছে যাবো গন্তব্যে। স্টেশনে ঢুকে দেখি ট্রেন আসতে আরো চার মিনিট, রাস্তা পার হয়ে যে উল্টো দিকের ট্রেনে উঠবো, তাও সময় সাপেক্ষ। তা ছাড়া এই নতুন লাইনের এই দিকটায় আমি এর আগে যাই নি। আজ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। সব কিছু দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। রিস্কি - কিন্তু যে রিস্ক নেয় না, সে শ্যাম্পেন খায় না। যাচ্ছি, যাচ্ছি, আর ঘড়ির কাটাটা নির্দয় ভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার হিসেবে মতো ৪-১০ এর পরিবর্তে ৪-১৪ তে পৌছুলাম ভ্লাদিকিনো স্টেশনে। দৌড়ে মেট্রোতে ঢুকে শেষ পর্যন্ত যখন সাভিওলেভস্কায়া স্টেশনে পৌছুলাম, ঘড়ি তখন ৪-৩০ ছুঁই ছুঁই। তার পরও বাস স্ট্যান্ডে গেলাম, দেখি সব নিঃশ্চুপ। বাসটা চলে গেছে আমাকে ফাঁকি দিয়ে।
কি করা? পরের বাস ৬.০০ টায়। ট্রেন ৫.৩০ এ। রেলওয়ে স্টেশনে ঢুকে টিকেট কিনে অপেক্ষায় সময় কাটলো নেট করে। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে চাইনি, এখন এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে। যাকগে, শেষ পর্যন্ত ট্রেন ছুটলো। আমিও বই পড়তে পড়তে, কখনওবা ঝিমুতে ঝিমুতে দুবনা পৌছুলাম। বিকালটা কি করে কাটাবো ভাবছি। একবার মনে হলো কাউকে ডাকি ছবি তোলার জন্য। এমন সময় মনে হলে এক লোকের সাথে দেখা করতে হবে পাশের বিল্ডিংয়ে। বাসায় ব্যাগ রেখে যখন ওর ওখানে যাবো ভাবছি, ঘড়িতে তখন ৭-৩৮। আচ্ছা, যদি সুইমিং পুলে যাই, ৮ টায় পৌঁছে যাবো। ৪৫ মিনিটের পরিবর্তে না হয় ৩০ মিনিট সাঁতরাবো, যদিও চাইলে ওরা আমাকে পরের শিফটে ঢুকিয়ে দেবে। আর যদি নাও দেয়, একটু হেটে আসা যাবে। তাই সাঁতারের সরঞ্জাম সাথে নিয়ে গেলাম প্রথমে পাশের বিল্ডিংয়ে। ও তাড়াতাড়িই বেরিয়ে এলো। তার পর এক রকম দৌড়ে চলে গেলাম সুইমিং পুলে। কদিন বরফ বৃষ্টির পরে গত দুদিন তাপমাত্রা প্লাস ছিল, তাই রাস্তা ভীষণ পিছল, তার পরেও কেমন করে যেন দ্রুত চলে গেলাম গন্তব্যে। আজ আর দু বার সাঁতার কাটা হলো না। এক বাড়ে ৪০০ মিটার সাঁতার কেটে চলে গেলাম ছাউনায়। যেহেতু নতুন বৎসরের আগে আর এস হবে না, তাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফুরফুরে মনে বেরিয়ে এলাম বাইরের ঠান্ডায়।
বাসায় গিয়ে রাঁধতে হবে। দোকানে যাবো কি? হঠাৎ মনে পড়লো, গত বুধবার যখন সকালে ছবি তুলি, এক মহিলা বলছিলো রাতে ভোলগার তীরে যেতে। এখানে অনেকেই আমাকে চেনে, জানে ছবি তুলি। তাই ওদের দৃষ্টিতে আকর্ষনীয় কিছু দেখলে আমাকে জানায় যেন সেখানে গিয়ে ছবি তুলি। তাই চলে গেলাম ভোলগার তীরে। রাত ৯-৩০ এর মতো। গ্রীষ্মে এখানে তিল পড়ার জায়গা থাকে না। এখন শুধু দু-চারজন লোক কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ ঠান্ডা আর প্রচন্ড বাতাস, তাই ওরাও নেই। হাটছি। সামনে পিছল পথ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোহালক্কড়। মনে হয় নদীতীরের রাস্তাটা প্রশস্ত করবে। নতুন ল্যাম্প - ডায়োড ল্যাম্প। চারিদিকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, পাশে বয়ে যাচ্ছে কালো নদী। দুদিন আগেও বরফে ঢাকা ছিল। বরফ আবার গলে গেছে নদীর বুকে। এই নির্জন নদী তীরে একা একা হাটতে একটু অস্বস্তি লাগছে। আবার ভালোও লাগছে একই সাথে।
বাসায় পৌঁছে প্রথমেই দেখলাম কিছু আছে কিনা। দেখি অর্ধেকটা বাধা কপি পরে আছে, আর সবুজ মূলো। কয়েকটা ডিম্, আর কয়েক টুকরো মাছ। আগামী তিন দিনে এসব শেষ করতে হবে। এর পর এক মাস এখানে কারো পা পরবে না। শুধু আমার কলিগ ভিক্তর মাঝে মধ্যে আসবে গাছে জল দিতে। রান্না করে খেয়ে দিয়ে ভাবছিলাম আজকের এই দিনটা নিয়ে লিখবো। কিংবা প্রচন্ড ক্লান্ত। ফেইসবুকে এক আধটা পোষ দেখলাম। এর মধ্যে দেখি কন্টাক্টে গুলিয়া স্টিকার পাঠিয়েছে
- চল যাই।
- চলো।
- তুমি এমন কি জিজ্ঞেসও করলে না কোথায়?
- এক জায়গায় গেলেই হলো। আসল কথা হলো যাচ্ছি তোমার সাথে।
দুবনা, ২২ নভেম্বর ২০১৬
গত সপ্তাহ থেকেই প্ল্যান ছিল কাপুস্তা কভাসিস মানে বাধা কপি নোনতা করার। দোকানেও পাওয়া যায়, তবে আমরা নিজেরাই করি। নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের প্রথমে, যাতে আগামী বসন্ত পর্যন্ত খাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ কেজি। বড় সংসারের সব কিছুই বড় বড়। দুবনায় আমার একার সংসারে এক কেজি চিনি কিনলে মাসের পর মাস চলে যায়, একই কথা অন্য সব কিছুতে। কিন্তু গ্রীষ্মে যখন ছেলে-মেয়েরা বেড়াতে আসে, আমি কেনার আগে সব শেষ হয়ে যায়, মনে হয় সারানচা (এক ধরণের পোকা, যা মুহূর্তে ক্ষেতের ফসল শেষ করে দেয়) পড়লো।
শনিবার জিনিষপত্র, মানে বাধা কপি, গাজর, বিট, রসুন এসব কিনে রাখলাম। ওই দিন আমাদের এক আড্ডা থাকায় কাজটা পিছিয়ে নেয়া হলো রোববার। রোববার আবার আপেল, সেলদেরই (এক ধরণের ধোনে টাইপ সবজি) কিনে আনা হলো। বাধা কপি, গাজর, বিট সব পরিষ্কার করতে করতে বেশ রাত। এছাড়া ক্রিস্টিনাকেও খুব ভোরে উঠতে হবে, সকালে ও একটা চার্চে সঙ্গীত কন্ডাক্ট করবে, তাই ঠিক হলো, সোমবার সকালে উঠে এসব করবো। আমার নিজেরই কিছু কাজ ছিল মস্কোয়, তাই দুবনা রাতে ফিরলেও হবে। তবে আমার প্ল্যান ৭ তার মধ্যে ফেরা যাতে সাঁতার কাটতে আর ছাউনায় বসে থাকতে পারি।
ক্রিস্টিনা উঠলো ৫ টায়, তারপর ওকে সকালের খাবারটা তৈরী করে দিলাম। আমি থাকলে ওরা আমার কাছেই এসব আবদার করে। এর পর গেলো সেভা তার স্কুলে। ওকে বিদায় দিয়ে আমি শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পরে উঠি উঠি ভাবছি এর মধ্যে আইকা, টেরি, টোট্টি, মার্সিক, ভার্দিক, লিসিয়ানা, এওলা আর মিকি - মানে আমাদের কুকুর গুলো আমার লেপের উপর আর নীচ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলো। একটু বিরক্ত হলেও সকাল বেলার এই ম্যাসাজ কিন্তু আমার খুব ভালোই লাগে। যতক্ষণ না গুলিয়া ওদের সবাইকে এক এক করে আদর করছে, আর সাবাস বলছে, ওদের এই প্যারেড শেষ হয় না।
মনিকার কাজ আজ ২ টা থেকে, তাই ও শুয়েই রইলো, আমরা শুরু করলাম কপি কাটা। এখানেও ছবির মতো, যখন মডেল খুব ক্লান্ত হয়ে পরে, ভালো ছবিগুলো তখনই আসে। আমার কাটাও প্রথম দিকে তেমন ভালো হচ্ছিলো না, কপির টুকরো গুলো ইয়া বড় বড় হয়ে যাচ্ছিলো, তবে শেষের দিকে গুলিয়া বললো, এখন টুকরো গুলো ঠিকঠাক হচ্ছে। যাই হোক বরাবরের মতো কপি, গাজর আর আপেল দিয়ে একটা বড় পাত্র পূর্ণ হলো। পরেরটা হলো কপি, বিট আর সেলদেরই দিয়ে। আর শেষ এক্সপেরিমেন্টালি একটা হলো কপি, বিট, মরিচ আর আদা দিয়ে। সবগুলোতেই কমন থাকে ক্লুকভা, লাল রঙের এক ধরণের বুনো বেরি। এবার এসব করার একটা স্পেশাল আগ্রহ হলো এই প্রথম গুলিয়া বললো সব ঠিকঠাক হলে দিদির জন্য কিছুটা পাঠাবে। ও আমাদের বাড়ীর কথা তেমন জিজ্ঞেস করে না, হঠাৎ কখনো কখনো দিদির কথা জিজ্ঞেস করে। কারণটা মনে হয়, এ দেশে মেয়েরাই সাধারণত মা-বাবার সাথে থেকে যায়, মা-বাবার দেখাশুনা করে, যেমনটা ছেলেরা করে আমাদের দেশে। তাই এখানে ভাইদের থেকে বোনদের খবরটা নেয়ার রেয়াজটাই বেশি। অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়।
কাটাকাটি যখন শেষের পথে গুলিয়া বললো
- আমরা যখন বুড়ো হবে, তুমি কপি কেটে দিও, আমি এসব তৈরী করে বাজারে বিক্রি করবো।
আমি প্রায়ই বলি, যখন চাকরী থেকে রিটায়ার করবো, তখন তো কিছু করার থাকবে না, দেশে চলে যাবো। ও খুব কষ্ট পায় এ কথা শুনে। মনে হলো, তাই আমার জন্য বৃদ্ধ বয়সে চাকরী খুঁজছে। আমি কিছু না বলে বললো
- না হয় কোনো এক বুড়ীকে বলবো আমাদের কপি বিক্রি করতে।
- আমরা যখন বুড়ো হবো, ঐসব বুড়ী তখন আর থাকবে না।
জানি না, অন্যেরা কি ভাবে, তবে আমরা কখোনোই নিজেদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখি না বৃদ্ধ বয়েসে। গ্রীষ্মে যখন ঘুরতে যাই, তখনও কোথাও বসে না থেকে সাগর থেকে পাহাড় পর্যন্ত ঘুরে বেড়াই, কখনো হেটে, কখনো বাসে বা ট্রেনে করে। ছবি তুলি, পাথর কুড়াই। তাই বসে বসে নাতি-নাতনিদের সাথে খেলা করার চেয়ে কপি কাটার আইডিয়া আমার কাছে অনেক সুখের মনে হয়। এক সময় মনে হতো ছেলে-মেয়েরা ছাড়া আমাদের মধ্যে কমন তেমন বেশি কিছু নেই। আজকাল মনে হয়, যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের পথদুটো যেন ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে।
যাহোক এসব করতে করতে বারোটা বাজলো। তারপর ভাবলাম খেয়েদেয়ে বেরুনো দরকার। ইচ্ছে ছিল ৩-৩০ বা ৪-৩০ এর বসে যাবো। তাতে করে ২ টোর দিকে বেরুলেই চলবে। এর মধ্যে ক্রিস্টিনা ফিরে এলো, মনিকাও বেরিয়ে গেলো। আমি অবশ্য ওদের আর নিজের জন্য দুপুরের খাবারটা তৈরী করে খেয়ে নিলাম এসবের মাঝেই।
আমার বাসা থেকে রাশিয়ান একাডেমী অফ সাইন্সের অফিস খুব দূরে নয়, দেখা যায়, কোনাকুনি হাঁটার পথ থাকলে মনে হয় ২ বা আড়াই কি.মি. তবে যেতে হবে ঘুরে, তাই বাস বা ট্রামে উঠতে হবে। ভাবলাম বাসে করে লেনিনস্কি প্রস্পেক্ট যাই, ওখান থেকে ট্রলিতে চলে যাবো। বাসা থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলাম, কিন্তু একেবারে নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গেলো ১১৯ নম্বর বাসটা। কি করা, উঠলাম ২৬ নম্বর ট্রামে, দু স্টপেজ পরে নেমে সেন্ট্রাল সার্কুলার ট্রেন লাইনের ক্রিমস্কায়া থেকে গেলাম গ্যাগারিন স্কয়ারে এক স্টেশন পরে। খুব পরিচিত জায়গা। বেরিয়ে দেখি আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গ্যাগারিন। একটা ছবি নিয়ে হাটছি সামনে। ওই তো দেখা যাচ্ছে রাশিয়ান একাডেমী অফ সাইন্সের বিল্ডিংয়ের ঝকঝকে চূড়া। কিন্তু সব কিছু এতো বদলে গেছে যে রাস্তা পাওয়া মুশকিল। যাই হোক, সেখানে গিয়ে নির্দিষ্ট এন্ট্রান্স পেতে লাগলো আরো মিনিট দশেক। শেষ পর্যন্ত এপ্লিকেশনটা বক্সে ফেলে ফিরে এলাম লেনিনস্কি প্রসপেক্ট মেট্রোর সামনে।
তখন ৩ -১৮। ৩-৩০ এর বাস আর পাচ্ছি না। ৪-৩০ পেয়ে যাবো। ভাবলাম যদি মেট্রোতে যাই সাভিওলেভস্কায়া যেতে লাগবে বড়োজোর ২৫ মিনিট, তার মানে প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা। অন্য উপায় - সেন্ট্রাল সার্কুলার ট্রেন লাইনে যাওয়া। যেহেতু সার্কুলার লাইন, দুভাবে যাওয়া যায় - ছোট বা ঘোরা পথে। প্রথমটায় গেলে লাগবে ৩০ মিনিট - আবার সেই অপেক্ষা। ঘোরা রাস্তায় গেলে আমি কাটায় কাটায় ৪-৩০ এ পৌঁছে যাবো গন্তব্যে। স্টেশনে ঢুকে দেখি ট্রেন আসতে আরো চার মিনিট, রাস্তা পার হয়ে যে উল্টো দিকের ট্রেনে উঠবো, তাও সময় সাপেক্ষ। তা ছাড়া এই নতুন লাইনের এই দিকটায় আমি এর আগে যাই নি। আজ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। সব কিছু দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। রিস্কি - কিন্তু যে রিস্ক নেয় না, সে শ্যাম্পেন খায় না। যাচ্ছি, যাচ্ছি, আর ঘড়ির কাটাটা নির্দয় ভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার হিসেবে মতো ৪-১০ এর পরিবর্তে ৪-১৪ তে পৌছুলাম ভ্লাদিকিনো স্টেশনে। দৌড়ে মেট্রোতে ঢুকে শেষ পর্যন্ত যখন সাভিওলেভস্কায়া স্টেশনে পৌছুলাম, ঘড়ি তখন ৪-৩০ ছুঁই ছুঁই। তার পরও বাস স্ট্যান্ডে গেলাম, দেখি সব নিঃশ্চুপ। বাসটা চলে গেছে আমাকে ফাঁকি দিয়ে।
কি করা? পরের বাস ৬.০০ টায়। ট্রেন ৫.৩০ এ। রেলওয়ে স্টেশনে ঢুকে টিকেট কিনে অপেক্ষায় সময় কাটলো নেট করে। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে চাইনি, এখন এক ঘন্টা বসে থাকতে হবে। যাকগে, শেষ পর্যন্ত ট্রেন ছুটলো। আমিও বই পড়তে পড়তে, কখনওবা ঝিমুতে ঝিমুতে দুবনা পৌছুলাম। বিকালটা কি করে কাটাবো ভাবছি। একবার মনে হলো কাউকে ডাকি ছবি তোলার জন্য। এমন সময় মনে হলে এক লোকের সাথে দেখা করতে হবে পাশের বিল্ডিংয়ে। বাসায় ব্যাগ রেখে যখন ওর ওখানে যাবো ভাবছি, ঘড়িতে তখন ৭-৩৮। আচ্ছা, যদি সুইমিং পুলে যাই, ৮ টায় পৌঁছে যাবো। ৪৫ মিনিটের পরিবর্তে না হয় ৩০ মিনিট সাঁতরাবো, যদিও চাইলে ওরা আমাকে পরের শিফটে ঢুকিয়ে দেবে। আর যদি নাও দেয়, একটু হেটে আসা যাবে। তাই সাঁতারের সরঞ্জাম সাথে নিয়ে গেলাম প্রথমে পাশের বিল্ডিংয়ে। ও তাড়াতাড়িই বেরিয়ে এলো। তার পর এক রকম দৌড়ে চলে গেলাম সুইমিং পুলে। কদিন বরফ বৃষ্টির পরে গত দুদিন তাপমাত্রা প্লাস ছিল, তাই রাস্তা ভীষণ পিছল, তার পরেও কেমন করে যেন দ্রুত চলে গেলাম গন্তব্যে। আজ আর দু বার সাঁতার কাটা হলো না। এক বাড়ে ৪০০ মিটার সাঁতার কেটে চলে গেলাম ছাউনায়। যেহেতু নতুন বৎসরের আগে আর এস হবে না, তাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফুরফুরে মনে বেরিয়ে এলাম বাইরের ঠান্ডায়।
বাসায় গিয়ে রাঁধতে হবে। দোকানে যাবো কি? হঠাৎ মনে পড়লো, গত বুধবার যখন সকালে ছবি তুলি, এক মহিলা বলছিলো রাতে ভোলগার তীরে যেতে। এখানে অনেকেই আমাকে চেনে, জানে ছবি তুলি। তাই ওদের দৃষ্টিতে আকর্ষনীয় কিছু দেখলে আমাকে জানায় যেন সেখানে গিয়ে ছবি তুলি। তাই চলে গেলাম ভোলগার তীরে। রাত ৯-৩০ এর মতো। গ্রীষ্মে এখানে তিল পড়ার জায়গা থাকে না। এখন শুধু দু-চারজন লোক কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ ঠান্ডা আর প্রচন্ড বাতাস, তাই ওরাও নেই। হাটছি। সামনে পিছল পথ। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোহালক্কড়। মনে হয় নদীতীরের রাস্তাটা প্রশস্ত করবে। নতুন ল্যাম্প - ডায়োড ল্যাম্প। চারিদিকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, পাশে বয়ে যাচ্ছে কালো নদী। দুদিন আগেও বরফে ঢাকা ছিল। বরফ আবার গলে গেছে নদীর বুকে। এই নির্জন নদী তীরে একা একা হাটতে একটু অস্বস্তি লাগছে। আবার ভালোও লাগছে একই সাথে।
বাসায় পৌঁছে প্রথমেই দেখলাম কিছু আছে কিনা। দেখি অর্ধেকটা বাধা কপি পরে আছে, আর সবুজ মূলো। কয়েকটা ডিম্, আর কয়েক টুকরো মাছ। আগামী তিন দিনে এসব শেষ করতে হবে। এর পর এক মাস এখানে কারো পা পরবে না। শুধু আমার কলিগ ভিক্তর মাঝে মধ্যে আসবে গাছে জল দিতে। রান্না করে খেয়ে দিয়ে ভাবছিলাম আজকের এই দিনটা নিয়ে লিখবো। কিংবা প্রচন্ড ক্লান্ত। ফেইসবুকে এক আধটা পোষ দেখলাম। এর মধ্যে দেখি কন্টাক্টে গুলিয়া স্টিকার পাঠিয়েছে
- চল যাই।
- চলো।
- তুমি এমন কি জিজ্ঞেসও করলে না কোথায়?
- এক জায়গায় গেলেই হলো। আসল কথা হলো যাচ্ছি তোমার সাথে।
দুবনা, ২২ নভেম্বর ২০১৬
Comments
Post a Comment