আমাদের সময়ের বুদ্ধিজীবী


আজ আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করছি, স্মরণ করছি সেই সব মানুষদের যারা বাহান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত, অর্থাৎ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির আপোষহীন যোদ্ধা, যারা ছিলেন শোষণ মুক্ত সমাজের স্বপ্নচারী। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি এঁদের হাত ধরে চলেছে ভাষার লড়াই, সংস্কৃতির লড়াই। এঁদের লেখনী, এঁদের দেশপ্রেম, বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের প্রতি এঁদের আনুগত্য জাতির রাজনৈতিক লড়াইকে পথ দেখিয়েছে, দিয়েছে নতুন মাত্রা। আর তার জন্য দিতে হয়েছে চরম মূল্য, একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে শুধু ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্তই নয়, এমন কি স্বাধীনতার ঠিক পরেও পাকিস্তানি সেনা আর এদের দেশীয় দোসরদের হাতে ঝরে গেছে কত প্রাণ। বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করার যে নীলনকশা রচনা করেছিল স্বাধীনতার শত্রুরা, স্বাধীন দেশেও সেটা পুরোপুরি রোধ করা যায়নি। বাংলার বুকে তাই আজও মুক্ত চিন্তার মানুষেরা নিরাপদ নন, আজও নব্য রাজাকার আর ধর্মান্ধদের ছুরিকাঘাতে ঝরে পড়ে মুক্তমনা মানুষের প্রাণ।


বুদ্ধিজীবী কারা? এ প্রশ্ন আজ অনেকের মনেই জাগে। কারণ একাত্তরে দেশের জন্য যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী প্রাণ দিয়েছেন, অথবা যারা জীবিত থেকে পরবর্তীতে দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন তাঁদের সাথে হাল আমলের বুদ্ধিজীবীদের মিল এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে এঁরা এক শ্রেনীর শিক্ষিত মানুষ যারা মানসিক শ্রমের মত জটিল কাজে লিপ্ত থেকে সমালোচনা ও পথ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সমাজের সংস্কৃতি ও রাজনীতি গঠনে নেতৃত্ব দানকারী ভূমিকা পালন করেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিজীবী শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত। বুদ্ধিজীবী যেমন সরকারের কাজকর্মের ঘোর সমালোচক হতে পারেন, তেমনি ভাবে সরকারের সমর্থকও হতে পারেন। তাই পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যেমন অনেক বুদ্ধিজীবী ছিলেন, তেমনি ছিলেন তার বিরোধী শিবিরের বুদ্ধিজীবীরা। তবে সাধারণ মানুষের যেটা আশা, সেটা হল বুদ্ধিজীবীরা যেন ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান, নিজেদের দলের ঊর্ধ্বে তুলে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখেন। পাকিস্তান আমল, বিশেষ করে একাত্তর আমাদের সামনে বুদ্ধিজীবীর যে আইডিয়াল তৈরি করে গেছে সে বিচারে এখন বুদ্ধিজীবী অনেকটা গালিতে পরিণত হয়েছে। এর জন্য রাজনীতিও কম দায়ী নয়। নিজেদের পক্ষে কথা বলাতে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মাণ ভূলুণ্ঠিত করেছে। সেই সাথে আছে সমাজে সর্বস্তরে ভোগবাদী আদর্শের উপস্থিতি। ভোগবাদ আজ ঈশ্বরের মতই সর্বভূতে বিরাজমান, সর্বশক্তিমান। এক সময় আদর্শ ছিল মানুষের অমূল্য সম্পদ, আজ আদর্শ আর দশটা জিনিসের মতই একটা পণ্য। আর দশটা বস্তুর মতই আদর্শও আজ বাজার অর্থনীতির নিয়মেই কেনা বেচা হয়। যে বেশি দাম দেয়, আদর্শের ধারক আর বাহকেরা তাদের কাছেই বিক্রিত হয়ে আদর্শ বিকৃত করে।


কথায় বলে যেমন জনগণ তেমনি তার সরকার। ঐ কথার সূত্র ধরে বলা যায়, যেমন জনগণ, তেমনি তার বুদ্ধিজীবী সমাজ। আসলে ওরাও তো জনগণেরই অংশ। যেখানে সমাজের সর্বস্তরে যেন তেন প্রকারেণ অর্থ উপার্জন করাই একমাত্র লক্ষ্য, মন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রামের চৌকিদার পর্যন্ত সবাই যেখানে এ দৌড়ে সামিল, সেখানে অন্য কিছু ভাবাটাই কষ্ট। কী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, কী আমাদের মন মানসিকতা সবই আজ মুক্ত চিন্তা বিরোধী। নিজের ছেলে কি করল তাতে আমরা যতটা না খুশি হই, প্রতিবেশির ছেলের সাফল্য দেখে আমরা তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাই। নিজের ঘরে কী ঘটছে তা নিয়ে আমাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই, অন্যের ঘরে যে আগুন লেগেছে তাতেই আমরা খুশি। অথচ আমার পাশের লোকটা যে আমার ভাই, আমার মায়ের পেটের সন্তান, আমার মত সেও হিন্দু বা মুসলমান, বৌদ্ধ না খ্রিস্তান, অথচ প্রায়ই দেখা যায় সেই আমার বড় শত্রু। আমার প্রথম লড়াই তার সাথেই পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে। তাই যদি হয়, তাহলে আমরা কীভাবে ভাবতে পারি একই জাতি, একই ধর্ম বা একই দলের লোক বলেই আমরা একে অন্যের সুখের যোগানদার? আমরা তখনই সামনে যেতে পারব, যখন অধিকারকে শ্রদ্ধা করতে শিখব। অন্যের অধিকারকে শ্রদ্ধা করা, মানে আইনকে শ্রদ্ধা করা, ন্যায়ের পথে চলা। সেটা না করতে পারলে আজীবন শুধু শত্রু খুঁজেই বেড়াতে হবে। সম্পদ হয়তো আসবে, কিন্তু সুখ আসবে না। মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়বে, স্বচ্ছলতা আসবে না। আধুনিক পোশাক গায়ে উঠবে, অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ঘর ভরে যাবে, কিন্তু আধুনিক মানুষ হয়ে উঠবো না।


তবে কি এর থেকে বেরুনোর পথ নেই? নিশ্চয়ই আছে। নিজেদের বদলানো, পাশের মানুষকে বদলানো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, তা সে যে ধরণের অন্যায়ই হোক না কেন। মনে রাখবেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করাটা সবাই অন্যায় মনে করেছিল বলেই প্রতিবাদ হয়েছিল। ২৪ বছরের লড়াই যতটা না পাকিস্তানের ধারণার বিরুদ্ধে ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল বাঙ্গালীদের প্রতি ওখানকার শাসক শ্রেণীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই স্বাধীনতাকে শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে দেখাটা ভুল হবে। আর সে জন্যেই দেশ স্বদেশীদের দ্বারা শাসিত হবার পরেও শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, যেমন বলতে হবে বিরোধী দলের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও। যদি আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এ কাজটা করতে পারেন, তবেই তারা বাংলার বুদ্ধিজীবীদের গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার হতে পারবেন। সেটা যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
মস্কো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি