রাস্তা

একাত্তরে আমাদের অঞ্চলে রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে ঢাকা আরিচা রোড। বলতে গেলে সেটাই ছিল একমাত্র পাকা রাস্তা তো বটেই, রাস্তা বলতে আমরা এখন যা বুঝি তাও। ভাবি তখন যদি গ্রাম বাংলায় আজকের মত রাস্তা থাকতো, গ্রাম বাংলা যদি দূর্গম না হত, যুদ্ধ আর কতদিন চলত, এর ফলাফলই বা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াত? তবে এটা ঠিক তখন পৃথিবীর এ অঞ্চলে যদি উন্নয়ণের ছোঁয়াচ লাগতো, যুদ্ধটাই হয়তো হত না। তাই যেকোন প্রশাসন যদি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেয়, তাহলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে, আর হলেও সেটা আয়ত্ত্বে আনা সহজ হয়।

যাই হোক, ফিরে আসি রাস্তার কথায়। সে সময়ে আমাদের গ্রামে আরো কিছু রাস্তা ছিল, ঢাকা আরিচা রোড থেকে জনাব আলী ভাইদের বাড়ী পর্যন্ত, মাঝখানে অনেকটা গ্যাপ, যেখানে রাস্তার দায়িত্ব পালন করতো জমির মধ্যে শুয়ে থাকা চওড়া বাতর বা আইল, এরপর গাঙ্গুলী বাড়ির ওখানে শুরু হতো আরেক রাস্তা, যেটা বাজার পেরিয়ে মির্জাপুর এলাকার নদীর সাথে মিশত। আমাদের বাড়ির পাশে রাস্তা ছিল মাল্টি পারপাস। শীতে রাস্তা হিসেবে কামলা দিতো, আর বর্ষায় খাল সেজে আমাদের মত অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে ডুব ডুব খেলত, বুকের উপর নৌকা চাপিয়ে চলে যেত আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামে। তখন অবশ্য গাড়ি ঘোড়া তেমন ছিল না। শুকনো মৌসুমে এই খাল দিয়েই গরুরা বিশ্রী শব্দ করে গাড়ি টানতে টানতে অনিচ্ছাকৃত ভাবে হাঁটতো এদিক ওদিক, আর সপ্তাহে দুই দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে পেটের ভেতর সুতা আর রং বোঝাই আমাদের বাড়ি আসতো দুটো ট্রাক। সেদিক থেকে গ্রামের ভেতরের রাস্তাগুলো অনেকটা বেকার জীবন যাপন করত বললেই ঠিক বলা হয়।

এখন অবশ্য অন্য ব্যাপার। বাংলার মাঠে মাঠে আগে যেখানে শুয়ে থাকত ডোরা সাপ, এখন সেখানে অজগরের মত শুয়ে আছে রাস্তা আর রাস্তা। ধূলো উড়িয়ে সেই রাস্তা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটছে ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কার। উন্নয়ণের আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার চাঁদনী রাত, হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলা। গ্রামের রাস্তায় চলছে রিক্সা, মানুষ ধীরে ধীরে হাঁটতে ভুলে যাচ্ছে।

এই রাস্তা অবশ্য নতুন আমদানী নয়। আমি যখন স্কুলে পড়ি, সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে দেশের সামরিক শাসক ঘোষণা দিলেন সবুজ বিপ্লবের, শুরু হলো খাল কাটা। কিন্তু খালের মাটি কোথায় রাখবে? ছোট বেলায় বোঁকা জামাইয়ের গল্প শুনেছি। জামাই গেছে শ্বশুর বাড়ি। বুদ্ধিসুদ্ধি কম, তাই বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে কথা না বলতে। একদিন শ্বশুর জামাইকে নিয়ে গেলো পুকুর পাড়ে, অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলো পুকুর খননের। জামাই ভাবলো, কিছু একটা না বললে ভালো দেখায় না, তাই খুব ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "শ্বশুর মশাই, সে তো বুঝলাম, কিন্তু পুকুরের এত মাটি খেলো কে?" শ্বশুর বললেন, "তোমাকে জন্ম দিয়ে তোমার বাবা খেয়েছে অর্ধেক আর তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে আমি খেয়েছি বাকি অর্ধেক।" তবে আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন জামাইরা এত বোঁকা ছিল না, তাই খাল কাটা মাটি দিয়ে পাশেই তৈরী হত রাস্তা। বরংগাইল থেকে ঘিওর পর্যন্ত যে রাস্তা সেখানে খুঁজলে আমার তোলা কিছু মাটি এখনো পাওয়া যাবে।

Bijan Saha, today at 22:05
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, রাস্তা। রাস্তা এখন সর্বত্র, ডাইনে বয়ে, ঘরে বাইরে - শুধু রাস্তা আর রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে শহর থেকে সাহেবরা গ্রামে আসে ছুটির দিনে, এ রাস্তা দিয়েই ধূলার মেঘে চারপাশ ঢেকে আসে ইট বা পণ্যভর্তি ট্রাক। ছুটে চলে গ্রামের রিকশাওয়ালা বেল বাজিয়ে। হেঁটে যায় অসংখ্য মানুষ এই রাস্তা দিয়ে সকাল সন্ধ্যা। আর রাস্তার পাশে যে টিস্টল সেখানে জমে প্রভাতী আর সান্ধ্য আড্ডা। রাস্তা রাস্তাই থেকে যায়, শুধু রাস্তার বুক মাড়িয়ে চলে যাওয়া মানুষেরা হয় ভিন্ন - কেউ ডাক্তার, কেউ ইন্জিনিয়ার, কেউ ড্রাইভার, কেউ রিকশাওয়ালা, কেউ বা গ্রামের সাধারণ শ্রমিক বা কৃষক।

স্বাধীনতাও তাই। একটাই তার নাম। শুধু আমরা মানুষেরা বিভিন্ন ভাবে স্বাধীনতার ফলভোগী। স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী তিরিশ লক্ষ মানুষ বা ইজ্জ্বত হারানো দুই লক্ষ মা বোন যেমন স্বাধীনতার ফসল, স্বাধীনতার পরে গড়ে ওঠা কালোবাজারীরাও সেই স্বাধীনতারই ফসল। একাত্তরে যুদ্ধের মাঠে দেশকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করার জন্য অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধা যেমন স্বাধীনতার ফসল, একই সময়ে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষদের হত্যাকারী আল বদর, রাজাকার এরাও সেই স্বাধীনতারই ফসল, যদিও আগাছা। আজকের প্রতিবাদী তরুণ সমাজ, মুক্তচিন্তার মানুষ যেমন স্বাধীনতার ফসল, তেমনি মুক্তকণ্ঠ রোধকারী মৌলবাদীরাও স্বাধীনতারই ফসল। আজকের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, আদর্শহীন বুদ্ধিজীবী - এরাও যেমন স্বাধীনতার ফসল, অধিকার আদায়ের জন্য অনশন ধর্মঘটে মৃত শ্রমিকেরাও এই স্বাধীনতারই ফসল। স্বাধীনতা এক ধরনের অমৃত সুধা যা বেহাত হলে বা অপব্যবহারে বিষ হয়ে যায়। স্বাধীনতা আমাদের মুক্ত করবে নাকি বন্দী করবে নতুন নতুন শেকলে সেটা নির্ভর করে আমাদের উপর। স্বাধীনতা একটা অধিকার, মানুষের জন্মগত অধিকার। অন্যের সেই অধিকার খর্ব করে নিজে স্বাধীন হওয়া যায় না, শুধুমাত্র নিজের চেয়ে শক্তিশালী আরো কারও পরাধীন হওয়া যায়। শুধুমাত্র দেশের সবাইকে স্বাধীন করে, সবার জন্য রুটি রুজির ব্যবস্থা করে, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করেই আমরা বলতে পারব আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আমরা বিজয়ী হয়েছি। বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার!

মস্কো, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি