ক্যাবলার প্যাঁচাল


ভারতে এখন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। মোদি সরকার আইন পাশ করেছে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে, সমাজের বাকী অংশ, বিশেষ করে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, বাম রাজনৈতিক দল, ছাত্র সমাজ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে, হচ্ছে মিটিং মিছিল। বাংলাদেশেও এই বিলের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছে তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে মিছিল করেছে সিপিবি। ফেসবুকের বাংলাদেশ ডোমেনেও তাদের প্রতি আছে সমর্থন। অনেকেই হ্যাস ট্যাগ নো ক্যাব আন্দোলন করছেন। আবার একই সাথে অনেকেই, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই এবং বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে যারা ভারতে এসে বসবাস করছেন, তাদের সমর্থন দেখছি বিলের পক্ষে। দু দলেই ব্যক্তিগত অনেক পরিচিত মানুষ থাকার ফলে, তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় হুট করে কিছু বলাটাও সম্ভব হচ্ছে না।

প্রথমেই আসি বাংলাদেশের কথায়। এখানে অনেককেই দেখছি যারা একই ঘটনা যখন বাংলাদেশে  ঘটে, মানে যখন বাংলাদেশে ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরনের সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হয়, তখন মুখ খুলেন না। গতকাল আপনি কোন ঘটনার প্রতিবাদ না করলে আজ যে সে ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করতে পারবেন না সেটা ঠিক নয়। তবে আপনার প্রতিবাদ কতটুকু আন্তরিক সেটা প্রমানিত হবে যদি আপনি একই ভাবে স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে ভবিষ্যতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেন। তা না হলে আপনার আজকের প্রতিবাদ যতটা না  অন্যায়ের (ধরে নিতে  পারি আপনি নাগরিক বিলটাকে অন্যায় বলে মনে করছেন, অন্তত সে কথাই বলছেন) বিরুদ্ধে, তার চেয়ে বেশি অন্যায় যে করছে তার বিরুদ্ধে। আমরা তো জানি ঘৃণা করতে হয় অন্যায়কে, কারণ অন্যায়কারী বদলায়, অন্যায় একই থাকে। তাই আসুন, যেখানেই সংখ্যালঘু বা দুর্বলের উপর অত্যাচার হোক না কেন,  সেটা প্যালেস্টাইন হোক, বার্মা হোক, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা – যেকোনো দেশেই হোক না কেন, আমরা একে না বলি।

'দিন আগে এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল।  সে যেখানে থাকে পশ্চিম বঙ্গের সে এলাকায় হিন্দু হবার পরেও তারা সংখ্যালঘু। নিজে রবীন্দ্র প্রেমী, তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম, রবীন্দ্রনাথকে  ভালবেসে কিভাবে এই বিলকে সমর্থন করা যায়? আবার বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন তাদের অনেকেই এই বিলকে সমর্থন করছেন। এদের অনেকেই দেশে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বন্ধু যখন আমাকে বলল «আমরা তো মিনি পাকিস্তানে থাকি, তাই এই বিলকে সমর্থন করি। তুমি এভাবে থাকলে নিজেও সেটা করতে।» «না, করতাম না। আসলে আমি খুব ভালো ভাবেই জানি নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হওয়ার বিড়ম্বনা। তাই কেউ নিজ দেশে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হোক সেটা চাই না।» ভাবলাম, আমাদের দেশের যে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা ইউরোপে বা অ্যামেরিকায় থাকেন,  নাইন ইলেভেনের পরে যারা দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক যে কি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, তারা সবাই কেন আমাদের দেশে ধরনের রাজনীতির বিরোধিতা করেন না, বরং এদের অনেকেই জামাতসহ বিভিন্ন মৌলবাদী দলের উগ্র সমর্থক। আমাদের দেশের বিশাল শ্রমিক বাহিনী যারা বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে প্রতি পদে পদে নিগৃহীত হয় স্থানীয় আরবদের দ্বারা তারা কেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের মিষ্টি কথায় বার বার প্রতারিত হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার পরেও!  

আমি যে ক্যাব সম্পর্কে যে খুব ভালো জানি তা নয়। যেটুকু জানা সেটা ফেসবুকের পাতা থেকেই। সেটাও বিভিন্ন ধর্মী লেখা পড়ে। খটকা আমার জন্যেই। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় এটা বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে যারা আসছেন তাদের জন্যে। জানি না ভারতীয় মুসলমান, মানে যারা ১৯৪৭ এর আগে থেকেই দেশে আছেন, তারাও কি এই নিয়মের আওতায় পরবেন কি না। মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সালে এখানে অনেক প্রিন্সলি স্টেট ছিল। কাশ্মীর বাদে সকল প্রিন্সলি স্টেটকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে জয়েন করতে বাধ্য করা হয় আর এর মধ্যে দিয়ে ভারত সরকার সে সমস্ত স্টেটের সমস্ত প্রজাদের দায়িত্ব নেয়। তাই দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও ভারত থেকে সব মুসলমান পাকিস্তানে যায়নি। ভারতের বিভিন্ন প্রিন্সলি স্টেটে থেকে যাওয়া মুসলিম প্রজাদের জন্য হলেও ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ থাকা উচিত ছিল। তার চেয়েও বড় কথা ভারতবর্ষে শুধু হিন্দু বা মুসলমান নয়, বিশাল সংখ্যক বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসিক, ইহুদী, খৃস্টানের বসবাস। এর বাইরেও আছে বিশাল বিশাল উপজাতি। এখানে স্মরণ করা দরকার যে ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অনুপাত ক্রমাগত কমলেও ভারতে তা কমেনি, বরং বেড়েছে। সেক্ষেত্রে ক্যাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আফগানিস্তান থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের ধর্মীয় আইডেন্টিটির উল্লেখ কতটা যৌক্তিক সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কেননা এসব দেশ থেক মুলত আসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা আসলেও সেটা নগন্য, সিন্ধুতে বিন্দুর মত তাই আমার মনে হয় বিজেপি এখানে যতটা না মুসলিম অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এটা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে এই ইস্যুতে দেশে একটা হল্লা হোক, নিয়ে দেশ দ্বিধাবিভক্ত হোক সেই চিন্তা থেকে। মনে রাখা দরকার, যেকোনো দেশেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হয়, সেই আবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করে। তাই চাইলে বিজেপি সরকার আবেদনকারীর ধর্ম দেখে সেটা মঞ্জুর বা নামঞ্জুকরতে পারত। সেটা করেনি, কারণ তারা চেয়েছে নিয়ে কথা উঠুক, জনগণ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার কথা ভুলে ক্যাব নিয়ে মেতে থাকুক। এক্ষেত্রে বিরোধী শক্তির উচিত হবে বিজেপির দুঃশাসন মাইনাস ক্যাব বিরোধী আন্দোলনকে দুঃশাসন প্লাস ক্যাব বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করা। ক্যাবের পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য ব্যর্থতার কথা সামনে নিয়ে আসা এবং এই আন্দোলনকে দুঃশাসন হটাও আন্দোলনে পরিণত করা।   
যারা ভাবছেন ক্যাবের মাধ্যমে এই তিন দেশ থেকে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর শেষ পর্যন্ত একটা হিল্লে হবে তাদের বলি, আপনাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য কোন এক জনগোষ্ঠীকে মার্কার দিয়ে চিহ্নিত না করলেও চলত। সত্যি সত্যি তারা আপনাদের অবস্থার উন্নয়ন চাইলে এত সব গোল না পাকিয়ে নাগরিকত্ব দিয়ে দিতে পারতেন। নতুন করে হিসাব করার কথা তখনই আসে যখন কেউ থেকে কোন সুবিধা আদায় করতে চায়। আর সেটা করা যায় আপনাদের ভাগ্যকে তাদের হাতের মুঠোয় রেখে।   আপনাদের সুখ শান্তি জিম্মি করে কেউ শান্তির প্রস্তাব নিয়ে আসলে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটা আরেকবার ভেবে দেখা দরকার। পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্রের লাড্ডু দেখিয়ে ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সরকার বদলালো। কই আজ এসব দেশে না আছে গণতন্ত্র না আছে শান্তি। ক্যাবও সেই অশান্তি আমদানীর ভারতীয় সংস্করণ।    
আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন গল্প পড়ি  ফেসবুকের পাতায়। আমি নিজেও এরকম গল্পের সাক্ষী। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে বেড়াতে গিয়ে যদি কোন ভাবে প্রকাশ পায় যে আপনি বাংলাদেশ থেকে, তখন আপনার প্রতি বাড়তি উৎসাহ প্রকাশ করে অনেকেই। একটু একটু করে আপনি জানতে পারেন সেই ভদ্রলোক বা তার পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশের লোক। তাদের বাল্যকাল কেটেছে বাংলাদেশের আলো বাতাসে অথবা বাবা-মা বা দাদু/দিদা মুখে বাংলাদেশের গল্প শুনে। আর সে গল্পে কখনোই বাংলাদেশকে ছোট করে দেখানো হয়নি। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলা মা যে এক মায়াময়ী রূপ নিয়ে বাস করছেন এদের অন্তরের অন্তঃস্থলে সেটা বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহ, তাদের ভালবাসাই বার বার প্রমাণ করে। আসলে এটা শুধু আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই নয়। আমার অনেক বন্ধু বান্ধব, যারা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা শেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা প্রায় সবাই একই রকম আগ্রহের সাথে এদেশের খোঁজ নেয়, জানতে চায় বর্তমান রাশিয়া বা বিভিন্ন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের কথা। তাই বাংলাদেশের মানুষকে পেয়ে তারা যে তাদের স্মৃতি বিজড়িত প্রিয় দেশের কথা জানতে চাইবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল তারা তাদের প্রতিবেশি হিসেবে বাংলাদেশীদের, বিশেষ করে বাংলাদেশী মুসলিমদের দেখতে চায় কি না। দেশ থেকে উচ্ছেদিত প্রতিটি পরিবারের পেছনেই নির্দিষ্ট কোন নাম বা ঠিকানা আছে, এই নাম ঠিকানার প্রায় সবগুলোই নিজ নিজ এলাকার, তার পরেও সব ছবি ছাপিয়ে সামনে চলে আসে প্রশাসনের মুখ, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মুখ। ফলে একদিন দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য মানুষেরা নতুন করে আসা সংখ্যালঘু শরণার্থীর মধ্যে যেমন নিজের অতীতকে দেখতে পায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে তেমনি দেখতে পায় সেই অত্যাচারী প্রতিবেশিদের যাদের কারণে একদিন তাকে সাত পুরুষের ভিটা ত্যাগ করতে হয়েছিল।  আর এ কারণেই ধর্মের প্রশ্নটা তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনে তারা যদি ধর্মের ধার নাও ধারে। সেই দুঃসহ স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার জন্য আমাদের দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলো অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে আর এ কারণেই সব দেশেই ধর্মীয় মৌলবাদের জয়জয়কার। আবার একই সাথে চলছে ইতিহাস বিকৃতি। ইতিহাস বিকৃত করার অর্থ হচ্ছে স্মৃতি থেকে অতীতকে মুছে দেওয়া, সমস্ত আবেগ, অনুভূতিকে ভোঁতা করে দেওয়া। আমরা কেন ছবি দেখে আবেগ তাড়িত হই? কারণ এতে ফেলে আসা দিন, ফেলে আসা সময় দেখতে পাই। দেখতে পাই পথের সাথীদের। যে বাড়িতে আপনার শৈশব কেটেছে, যে গ্রামে আপনি বড় হয়েছেন, আজ যদি তা অন্যের হাতে পড়ে রূপ বদলায়, আপনার কষ্ট হয় সেখানে নিজেকে ফিরে দেখতে। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে, আশা থাকে আজ হোক, কাল হোক তার সাথে দেখা হবে। কিন্তু কেউ মরে গেলে সেই সুযোগ আর থাকে না। এই “আর হবে না”র কারণেই কোন মৃত্যু সংবাদ শুনে আমরা এত ব্যথিত হই। এটা যত না মৃতের জন্যে, তার চেয়ে বেশি নিজের জন্যে, একটা সম্ভাবনার দ্বার বন্ধ হয়ে গেল বলে। ইতিহাস মুছে ফেলাও একই রকম। ইতিহাস বিকৃত করা বা মুছে ফেলা মানে অতীতের সাথে, পূর্বপুরুষদের সাথে একটা অভেদ্য, স্থায়ী দেয়াল তৈরি করা। তাই অতীতকে যতই ঘোলাটে করা যায়, ধর্ম, বর্ণ, জাতি – ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের দেওয়ালকে ততই মজবুত, ততই উঁচু করে তোলা যায়। দ্বিজাতি তত্ত্বের মত ক্যাবও সেই দেওয়ালের আরও একটা ইট মাত্র। দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্যে যে দীর্ঘ মেয়াদী বিভেদের বীজ রোপিত ছিল সেটা বুঝতে খুব বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই।  ইকবাল পাঞ্জাব, কাশ্মীর, সিন্ধু আর বেলুচিস্তানকে ঘিরেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলা তার ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না, যদিও এই বাংলাই ভোট দিয়ে পাকিস্তানের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে।  কাশ্মীর বিহীন পাকিস্তান যে তার নামের সার্থকতা অপূর্ণ রাখবে সেটা না বোঝার কথা ছিল না, তাই কাশ্মীরকে না ভারত, না পাকিস্তান করার ব্রিটিশ পলিসি যে দু দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করবে সেটা নতুন কিছু নয়। সেই উত্তেজনা এখনও কমেনি, বরং বাড়ছে। এখনও অনেকেই স্বপ্ন দেখে কবে ভারত বা পাকিস্তান ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। চোখের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত একটা মহা পরাক্রমশালী একটা দেশকে ভেঙ্গে যেতে দেখে এসব কিছুই আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হায় না। আবার এটাও জানি দীর্ঘ দিন একই ঘরের নীচে বাস করে হঠাৎ করে আলাদা হওয়ার যন্ত্রণা। ভাগাভাগি কখনই শান্তিপূর্ণ বা বেদনাহীন হয় না (চেকস্লাভাকিয়া এ ক্ষেত্রে মনে হয় ব্যতিক্রম), এমন কি হলেও জীবনের সব কিছু এত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে সেটা সব সময়ই কোন না কোন দাগ কাটে পরবর্তী জীবনে। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখা যায় নুনটা এ ঘরে তো চিনিটা অন্য ঘরে। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের প্রায় সব দেশই সেটা দেখেছে, এই আঘাত অনেক দেশ এখনও পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যতদূর জানি, আমাদের সব দেশে সমাজে ভাঙ্গন সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক শক্তিকে সমর্থন করে মূলত পুঁজিপতিরা। তারা কি বোঝে না যে সমাজ বা দেশ ভাংলে শেষ পর্যন্ত তাদের ব্যবসায়ই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে?
অনেকেই এসব কাজকর্মের জন্য ধর্মকে দোষারোপ করে। ধর্মের নিশ্চয়ই হাত আছে এতে, বিশেষ করে ধর্ম ব্যবসায়ী ও ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করে তাদের। কিন্তু ধর্ম এককভাবে দায়ী নয়। ধর্মকে ব্যবহার করা হয় মাত্র। এই যে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজে ধর্মকে ব্যবহার করা যায় বা যাচ্ছে, এটাই ধর্মের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। একটা শিশু কোন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে সেটা তার উপর নির্ভর করে না। এক্ষেত্রে তার কোন হাত নেই। কোন একটা শিশু ধনীর বা দরিদ্রের ঘরে জন্ম নিলে আমরা তো তাকে দোষ দিই না, তবে সেই শিশুই হিন্দু বা মুসলিম বা অন্য কোন ধর্মের বাবা মার ঘরে জন্ম নিলে আমরা সেটাকে ভিন্ন ভাবে দেখি কেন? কেন আমার ব্যর্থতার জন্য অন্যকে দায়ী করতে হবে? আমি ক্লাসে ফার্স্ট না হলে সেটা কি অন্যের দোষ? জীবনে প্রতি পদে পদে আমাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, নিজে যদি জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, শক্তিতে শ্রেষ্ঠ না হই তাহলে অন্যেরা তো আমাকে টপকে যাবেই। এখানে মনে পড়ছে এক পুরনো চুটকি।
একদিন কাক ডাকা ভোরে আব্রাহামকে সেজেগুজে বাইরে যেতে দেখে সারাহ জিজ্ঞেস করল
- কোথায় যাচ্ছ এই সাত সকালে?
- জান, গতকাল এক জ্ঞানী লোক বলেছেন যে সকালে ওঠে ঈশ্বর তাকে সাহায্য করেন।
কিছুক্ষণ পরে আব্রাহাম ফিরে এসেছে। নাক মুখ ফোলা, জামাকাপড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন।
- কি ব্যাপার, ফিরে এলে যে? এ অবস্থা কেন তোমার?
- আর বলো না। কেউ একজন আমার চেয়েও আগে ঘুম থেকে উঠেছে।

আমি নিজে যদি কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকি আর অন্যদের নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করি, কেউ না কেউ ঠিকই আমার চেয়ে আগে ঘুম থেকে উঠবে, জীবনের দৌড়ে আমার চেয়ে আগে ছুটবে।

হ্যাঁ, আপনি চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোন রাম, শ্যাম, জদু, মধুকে যেমন ভারতে যেতে বাধ্য করতে পারেন, ঠিক তেমনি ওদিকেও চাইলে কোন রহিম, করিম, ইমরান, আকরামকে ভারত ত্যাগে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু এখানেই আপনাদের ক্ষমতার দৌড় শেষ। শত চাইলেও আপনারা এই উপমাহাদেশ থেকে এ দেশগুলোকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারেন না, চান আর নাই চান, আপনারা চিরতরে একে অন্যের প্রতিবেশিই থাকবেন। আর সেটাই যদি হয়, কি অসুবিধা সেই থাকাটা মধুময় করে তুলতে? এক সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দশকের পর দশক একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, কই এখন তো তারা নিজেদের সেই বিরোধটাকে কমিয়ে আনতে পেরেছে, বলতে গেলে সবাই মিলে আবার একই দেশে বসবাস করছে। আর এ থেকে সবাই লাভবান হচ্ছে। আমাদের বুঝতে হবে ধর্ম নয়, এসব দুর্গতির মূলে রয়েছে অর্থনীতি। ধর্মই যদি কারণ হত তবে আরব বিশ্ব, যেখানে অন্য ধর্মের লোক নেই বললেই চলে সেখানে তো দরিদ্র থাকার কথা ছিল না। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে মুসলমানদের দরিদ্র, নিপীড়িত হওয়ার কথা ছিল না। তাহলে তো ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হত না। চোখ খুলুন, দেখুন আপনার জীবনে এই যে হাজার হাজার মানুষের সাথে আপনার ওঠা বসা, সেখানে অন্য ধর্মের কম মানুষ নেই। আপনার বন্ধুদের তালিকা করে দেখেন, সেখানেও তাদের দেখা পাবেন আবার একই সাথে শত্রু তালিকায় পাবেন নিজের ধর্মের অনেককে। শোষণ করা ছাড়া শোষকের অন্য কোন ধর্ম নেই। শোষক সবাইকে শোষণ করে, তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলিমই হোক। তাই প্রকৃত যারা মানব মুক্তি চায় তারা হিন্দু বা মুসলমানমুক্ত সমাজের কথা বলে না, বলে শোষণমুক্ত সমাজের কথা। সমাজ থেকে শোষণ আর শোষক তাড়াতে পারলে আপনাকে আর বিধর্মীদের তাড়াতে হবে না।   

অনেকের ধারণা আমাদের দেশগুলোর মধ্যে কোন মিল নেই, ব্রিটিশ আমলে অনেকটা জোর করে একটা যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছিল। একদিকে হিমালয়, অন্য দিকে ভারত মহাসাগর এ অঞ্চলের মানুষকে ইচ্ছা অনিচ্ছায় একই সাথে থাকতে বাধ্য করেছিল। প্রাচীন কাল থেকেই শুধু যুদ্ধ বিগ্রহ নয়, ব্যবসা বানিজ্য চলে আসছিল বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে। ভাষার পার্থক্য থাকলেও এ অঞ্চলের প্রায় সব ভাষাই জন্ম নিয়েছে সংস্কৃত থেকে। কাওয়ালি, ভাটিয়ালী, ভজন, গজল, হিন্দুস্তানী, কর্ণাটকি ভিন্ন হলেও এই বিস্তীর্ণ এলাকার সবার মনেই দোলা দেয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তো সীমানা পেরিয়েছে সেই কবেই।               
             
   
মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেলে কথায় কথায় দেশ ভাগ নিয়ে কথা উঠে। আমি বরাবরই দেশভাগের বিপক্ষে, সেটাই বলি। কিন্তু তাদের পাল্টা যুক্তি, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ না হলে আজ বাংলাদেশ হত না। তাহলে আজ আমাদের কাশ্মীরের অবস্থা হত। আশ্চর্য! ভারত ভাগ না হলে কাশ্মীরের সমস্যা যে আদৌ থাকতো না সেটা কেউ ভাবতেও চায়না। কেউ ভাবে না আজ ভারত-পাকিস্তান, ভারত-বাংলাদেশ, বাংলাদেশ-পাকিস্তান ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের যে শত শত সমস্যা সমাজে বিদ্যমান সেটা এই দেশ  ভাগকে কেন্দ্র করেই। অবিভক্ত ভারতে বাংলা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রদেশ। আজ ভারতে যেমন ইউ পি বা পাকিস্তানে পাঞ্জাব ডমিনেট করে, অবিভক্ত ভারতে তেমনটা হত না, শক্তির ব্যাল্যান্স থাকত একেবারে ভিন্ন। তাই বর্তমানের অনেক সমস্যা কখনও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারত না। তবে আমার দেশভাগের বিরোধিতা মানে এই নয় যে আমাদের আবার ৪৭ এর আগে ফিরে যেতে হবে। আমি যেটা চাই, সেটা এ নিয়ে আবেগ নয়, নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করে ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে। অনেকেই বলে দেশ ভাগ না হলে ভারতের মুসলিমরা হিন্দুদের দ্বারা শোষিত হত। আমার ঠিক তেমনটা মনে হয়না। মানুষ শোষিত হয় শোষকের দ্বারা। পাকিস্তান বা বাংলাদেশে কী মুসলিম পুঁজিপতিরা মুসলিমদের শোষণ করছে না? একই ঘটনা কী ঘটছে না ভারতেও? সেখানেও তো হিন্দু পুঁজি হিন্দু প্রজাদেরই শোষণ করছে। আগেও বলেছি পুঁজির যেমন ধর্ম নেই, শোষকেরও তেমনি ধর্ম নেই, ঠিক যেমন কিনা ধর্ম নেই শোষিতের। শোষকেরা ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষিতের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের শোষণ করার পথটা কণ্টক মুক্ত করে, এই আর কি। ভাবুন আপনি কোন একটা কাজে সফল হচ্ছে না বা ঠিক যে ধরনের ফলাফল আশা করেছিলেন, সেটা পাচ্ছেন না। আপনি কি করবেন? প্রথমত চেষ্টা করবেন আপনার কর্ম পদ্ধতিতে কিছু রদবদল আনতে। তাতে ফল না পেলে আপনাকে পুরো প্রোজেক্টটাই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে বা  প্রজেক্টটা যে সঠিক ছিল না সেটা মেনে নিয়ে নতুন ভাবে শুরু করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না আপনি নিজের এই ভুলটাকে স্বীকার করছেন, আপনাকে ব্যর্থতার মধ্যেই আবর্তিত হতে হবে। দেশ ভাগের ক্ষেত্রেও একই কথা সাজে। কারণ যতদিন আপনি মনে করবেন সেটা ঠিক ছিল ইচ্ছা অনিচ্ছায় আপনাকে কতগুলো জিনিস মেনে নিতে হবে, আর সেটা হল যে ভিত্তি বা আইডিয়ার উপর আপনি সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিলেন সেটা আঁকড়ে থাকা আর একই সাথে তার সমস্ত বাই প্রোডাক্টের ফলাফল মেনে নেওয়া। চান আর নাই চান আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে হিন্দু ও মুসলমান দুই ভিন্ন জাতি, তাদের একসাথে থাকা, চলাফেরা সম্ভব নয়। আর যাদের সাথে আপনি থাকতে পারবেন না, যাদের আপনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে মেনে নেবেন না তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কেমনে করবেন? তাই উপমহাদেশে শান্তির প্রধান শর্ত ভারত বিভাগ ভুল ছিল সেই সত্যকে স্বীকার করা। ভুল এ কারণে যে যে সব সমস্যার সমাধানের জন্য দেশ ভাগ হয়েছিল তার একটারও কোন সমাধান হয়নি, বরং নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে, হচ্ছে। যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে দেশ ভাগের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল এটা ভাবার অনেক কারণ আছে যে দেশ ভাগকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য কৃত্রিম ভাবে সেসব দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল। অর্থাৎ হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার জন্য দেশ ভাগ হয়নি, দেশ ভাগের জন্য দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন, কী হবে এখন এসব কথা তুলে, পুরনো দিনের ভুল স্বীকার করে? প্রথমত এই ভুল স্বীকারের ফলে সরকারি ভাবে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস কমবে, পরস্পর বিরোধী প্রোপ্যাগান্ডা বন্ধ হবে। সাথে সাথে কমবে দুই দেশের মানুষের প্রতি পরস্পারিক ঘৃণা। কমবে উত্তেজনা। আর সবচেয়ে বড় কথা ধর্মকে আর রাজনীতির খেলায় ব্যবহার করা যাবে না। আজ দেশে দেশে উগ্রপন্থীদের উত্থানের মূল কারণ সীমান্তের ওপারের শত্রুভাবাপন্ন সেনাবাহিনী/জনতা। যদি রাজনীতির মঞ্চ থেকে বিদ্বেষটাই উঠিয়ে দেওয়া যায় তাতে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সুস্থ রাজনীতির বিকাশের পথ খুলে যাবে। তাহলে আর কথায় কথায় কাউকে দেশদ্রোহী বলে গালি দিতে হবে না, কাউকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে হবে না। কে জানে, হয়তো একদিন আমরাও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মত একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব, যখন এ এলাকার জনগণ বিনা ভিসায় এদেশ থেকে ওদেশ যেতে পারবে, চাকরির পথ খুলে যাবে। তখন আর বহিশক্তি আমাদের বিভেদকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারবে না।
তবে এটা ঠিক আমাদের দেশগুলোর সমস্যার সমাধান করতে হলে ধর্মের ফ্যাক্টরটা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। ইচ্ছা অনিচ্ছায় সেটা সামনে চলে আসবে, এমন কি আমরা সবাই যদি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে দেখতে চাইও। কারণটা আমাদের পারিবারিক শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। মনে রাখতে হবে হিন্দু ধর্ম এক দিকে যেমন একেশ্বরবাদী, অন্য দিকে একই ঈশ্বরের বহু রূপেও বিশ্বাসী, অন্য দিকে ইসলাম ধর্ম একেশ্বরবাদী, ঈশ্বরের একাধিক রূপের স্থান সেখানে নেই। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই জীবন দর্শনে গড়ে ওঠা শিশু মনে সেটা চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে নিজের জীবনের একটা উদাহরণ দিতে পারি। আমি যখন ১৯৯৪ সালে দুবনায় জয়েন করি, তখন কাজ করতাম থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে। ওখানে সবাই নিজেকে একেজন ছোটোখাটো দেবতা বলে মনে করে আর কোন ব্যাপারে নিজের তত্ত্বকেই শেষ কথা বলে মনে করে। আমার যে লোকাল বস ছিলেন উনি প্রায়ই বলতেন, “ঐ লোকটা একটা গাধা, ও কিছুই বোঝে না।“ ইত্যাদি ইত্যাদি। যার বা যাঁদের সম্পর্কে বলতেন তারাও নামকরা বিজ্ঞানী। আমি এসবে কান দিতাম না। বড় জোর বলতাম, “দেখুন, আমার এক ভাই কালীর ভক্ত, অন্য ভাই কৃষ্ণের। মা দুর্গা পূজা করেন, মাসিমা শিবের অনুরাগী। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কারও সাথে ঝগড়া বিবাদ করে না, কেউ কারও দেবতার নিন্দাও করে না। তারা সবাই বিভিন্ন পথে একই সত্যের সন্ধান করে। তাই আপনারা কে ঠিক, কে ভুল, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি আমার মত করে সত্যের সন্ধান করি। কোয়ান্টাম তত্ত্ব যদি একাধিক পথে আলোর কনাকে উৎস থেকে পর্দায় পড়তে দেয়, আলো যদি একই সাথে কনা ও তরঙ্গ হতে পারে তাহলে আমরা বিজ্ঞানীরা কেন ভিন্ন ভিন্ন পথে সৃষ্টি রহস্য আবিষ্কার করতে পারব না?” কয়েক বছর আগেও বিশ্ব বিখ্যাত কসমোলজিস্ট প্রোফেসর আলেক্সেই স্তারবিনস্কি আমার ডার্ক এনার্জির স্পিনর মডেলকে পাত্তা দিতেন না। গত বছর বললেন, “এখন সৃষ্টি রহস্য জানার জন্য অনেক ভালো ভালো থিওরি আছে। তবে এসব থিওরির একটাই সঠিক।“ আমি হেসে বললাম, “যদি মহাবিশ্ব ধ্বংসের পরে আবার নতুন করে জন্ম নিতে চায়, তার অন্তত জানা থাকবে কোন পথে যেতে হবে না। সে তখন বাকী ভালো থিয়োরিগুলো থেকে একটা বেছে নিতে পারবে।“ মহাবিশ্ব এক জটিল প্রক্রিয়া। যেমন জটিল প্রকৃতি। সমস্যার সমাধান বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বেশ কিছু সমাধান আছে, যাকে আমরা বলি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ বাইরের কোন শক্তি যখন নিজে প্রভাবিত না হয়ে সমস্ত প্রক্রিয়াটাকে প্রভাবিত করে। আবার ভেতরেরই অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কেউ অন্যদের ডমিনেট করে কখনও কখনও কোন একটা সমাধানে পৌঁছে। এসব সমাধান স্থিতিশীল নয়, কেননা প্রথম সুযোগেই অন্যদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। আবার কিছু সমাধান আছে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে সব উপাদানের অধিকার স্বীকার করা হয় এবং প্রত্যেকেই একে অন্যকে প্রভাবিত করে। এসব সমাধান হয় অনেক স্থিতিশীল। আমরা যদি এই ভূখণ্ডে পার্মানেন্ট শান্তি চাই, তবে এখানে বসবাসকারী সবার স্বার্থ দেখতে হবে, সবাইকে দেশ বা উপমহাদেশ গঠনে সক্রিয় করতে হবে। ধর্মকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে শিশুদের অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাতে হবে। এক কথায় বিগত প্রায় পঁচাত্তর বছর যে বিভেদের বীজ রোপণ করা হয়েছে, এখন ধর্মসহ বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই সেটা ঐক্যের গাছে পরিণত করতে হবে। আর সেটা করতে পারলেই শত্রু সম্পত্তি আইন, ক্যাব ইত্যাদি বিভিন্ন রকম বিভেদ মূলক নিয়ম কানুন এমনিতেই অপ্রয়োজনীয় হবে। তাই আজ যারা ক্যাব, শত্রু সম্পত্তি আইন ইত্যাদি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন বা কথা বলছেন একই সাথে তারা যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মন্ত্রে এদেশগুলোর অধিকাংশ মানুষকে দীক্ষিত করতে না পারেন, যদি ধর্ম ব্যবসায়ী ও ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করে তাদের বলয় থেকে সাধারণ মানুষকে বের করে আনতে না পারেন, তবে এই আন্দোলন, এই আত্মত্যাগ দীর্ঘ স্থায়ী সাফল্য বয়ে আনতে যে পারবে না বর্তমান বাংলাদেশ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তাই জাতের জন্য নয় ভাতের জন্য লড়াইটাকে একই সাথে মানুষ হওয়ার লড়াইতে পরিণত করাটা আজ সময়ের দাবী।   

দুবনা, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯


       

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি