ইতিহাস

ইদানীং ফেসবুকে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক নিবাসে সাইকেল গ্যারেজ করা নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। অনেকেই সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটকের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি সংরক্ষণের দাবী জানিয়েছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে প্রথম হাউজ মিউজিয়ামের সাথে পরিচিত হই। সাহিত্য, শিল্প থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা অবদান রেখেছেন তাদের শৈশব, কৈশোরসহ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যেখানে কেটেছে সেটা সংরক্ষণের চেষ্টা করা হত, এখনও হয়। বড় বড় শহরে পুরনো বিল্ডিংএর গায়ে প্রায়ই ফলক লাগানো থাকে " প্রখ্যাত সোভিয়েত ... সাল থেকে সাল পর্যন্ত এই বাড়িতে বাস করেছেন। ......" জার রাশিয়ার বিখ্যাত মানুষজন, যাদের ছোট হোক বড় হোক, নিজস্ব কোন বাড়ি ছিল, সেটা তো ছোটখাটো জাদুঘর। দেশ বিদেশ থেকে মানুষ আসে এসব বাড়িতে। টিকেট কেটে সেসব বাড়ি দেখে। ভারতের পুনায় গান্ধীর স্মৃতি জড়িত এমন একটা বাড়ি আছে, যেমন এলাহাবাদে আছে নেহেরুর আনন্দ ভবন। ইতালীর ট্রিয়েস্ট থেকে একটু দূরে আছে সেই হোটেল যেখানে বোল্টসম্যান আত্মহত্যা করেছিলেন। আসলে দেশের কৃতি সন্তানদের সম্মান দেওয়া দেশ ও জাতির সংস্কৃতির অঙ্গ। ২০১৬ সালে দেশে গিয়ে দেখলাম বর্তমানের অনেক রাজনৈতিক নেতাদের নামে রাস্তাঘাট। অথচ যুগ যুগ ধরে যারা আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে বলতে গেলে নিজের উদ্যোগে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছেন তাদের প্রতি আমাদের অবহেলার অন্ত নেই। ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলাই কী বাংলাকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নেয়নি? তাই যদি হয় তাহলে কেন আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের যথাযথ সম্মান দেখাতে পারব না? আগামী বছর ইংল্যান্ডে আচার্য জগদীশ বসুর প্রতিচ্ছবি সহ নোট বেরুবে। আমরাও কি পারি না আমাদের দেশের সন্তানদের এভাবে শ্রদ্ধা দেখাতে? দেশে তো দরগাহ, আশ্রম এসবের অভাব নেই, তাহলে বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প - এসবের প্রতি আমাদের এত কার্পণ্য কেন? রবীন্দ্রনাথ, রবি শঙ্কর, সত্যজিত রায়দের মত আর কে বাংলা ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছে? জগদীশ বোস, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মত আর কোন বাঙালী বিজ্ঞানী বাংলাকে বিজ্ঞান বিশ্বে পরিচিত করিয়েছে? আমরা কী আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস বাদ দিয়ে বাঙালী জাতির কথা ভাবতে পারি? নাকি "হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান" বলার মধ্য দিয়েই বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের প্রতি আমাদের সমস্ত দায় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আসলে একটা জাতির ইতিহাস শুধু তার রাজা বাদশাদের ইতিহাস নয়, জাতির ইতিহাস তার জয়-পরাজয়ের ইতিহাস, তার কৃতি সন্তানদের ইতিহাস, তার সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলার ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করাটাও ইতিহাস বিকৃত করা, অতীতের সাথে বর্তমানের দেয়াল তৈরি করা, জাতিকে ছিন্নমূল করা। নিজের ইতিহাস না জানা অনেকটা পিতৃত্বের পরিচয় না জানারই সমতুল্য। আমরা কী আমাদের ঐতিহ্য ভুলে, ইতিহাস ভুলে এমন একটা জাতিই তৈরি করতে চাই?

দুবনা, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ 
 
 
 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি