পথচলা


অনেক দিন পর আজ ক্রিস্টিনার ছবি তুললাম। ও দুবনা এসে পৌছুলো বিকেল সাড়ে পাঁচটায়, মস্কো ফিরে গেল রাত দশটার ট্রেনে। গতকাল ওর জন্মদিন ছিল। ২০০৯ সালের আগে পর্যন্ত যখন সবাই একসাথে দুবনায় ছিলাম,  সবার জন্মদিন পালন করতাম হৈ হুল্লোড় করে। ওদের আর আমাদের বন্ধুবান্ধবরা আসত। যেহেতু এখানে না আমার না গুলিয়ার - কোন আত্মীয় স্বজন ছিল না, জন্মদিনে বন্ধুরাই আসত। ২০০৯ সালে ওরা মস্কো চলে যায়, ফলে আগের মত করে একসাথে আর বসা হয়ে ওঠে না। ছুটির দিন হলে আমি মস্কো যেতাম, নইলে ওরা নিজেরাই পালন করত একটা সময় পর্যন্ত। গুলিয়া যত্ন করে টেবিল সাজাত। তারপর ওরা জন্মদিন পালন করতে শুরু করে ক্যাফে বা বারে নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের সাথে। এখন যখন বাচ্চারা মস্কো থাকে আর আমরা দুবনায় - ওভাবে কিছু হয় না। উপহার হিসেবে ওরা চায় আর পায় একটা অংকের টাকা, খরচ করে নিজেদের মত। এছাড়া কেক, শ্যাম্পেন ইত্যাদির জন্য আলাদা একটা অংক। আমরা এখানে এ উপলক্ষে নিজেরাও কেক কাটি, শ্যাম্পেন বা ওয়াইন তুলে ওদের স্বাস্থ্য পান করি। অনুপস্থিতিতেও জন্মদিন পালন করা আমাদের বাড়ির ট্র্যাডিশন। আমার যেসব দাদারা কোলকাতা ছিল ওদের জন্মদিনে মা সব সময় বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। আমি ৩৭ বছর আগে দেশে থেকে চলে এলেও এখনও বাড়িতে যারা, ওরা এ উপলক্ষ্যে খাওয়া দাওয়া করে। 

ক্রিস্টিনার জন্ম ১৯৯৮ সালের ৯ ডিসেম্বর, রাশিয়ার সব চেয়ে কঠিন সময়ে। আন্তন আর মনিকাকে নিয়েই তখন আমাদের হিমশিম অবস্থা। ক্রিস্টিনা যখন ওর আগমন জানান দিল আমরা খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। প্রশ্ন এলো রাখা না রাখার। তবে কে সিদ্ধান্ত নেবে? আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলি না, যদিও জানি কিছু একটা করা দরকার। বিশেষ করে ঐ সময় বেতন বলতে গেলে তো ছিলই না, কাজ কতদিন থাকবে সেটাও ছিল প্রশ্ন সাপেক্ষ। ১৯৯৬ সাল থেকে দুবনায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করলেও প্রায়ই মস্কো যেতাম। একদিন মেট্রোতে যাচ্ছি সবাই মিলে। সেখানে একটা পোস্টার চোখে পড়ল। তাতে লেখা "গর্ভপাত শিশু হত্যা"। আমি মেট্রো থেকে বেরিয়েই গুলিয়াকে বললাম, আমি তোমাকে গর্ভপাত করতে বলে শিশু হত্যায় প্ররোচিত করব না, তবে তুমি যদি চাও, আমি বাধা দেব না, তোমার পাশেই থাকব।  

গুলিয়ার ইচ্ছে ছিল ওর নাম ভাসিলিসা রাখার ওর দিদিমার নামে। অনেকগুলো অপশন দেখে শেষ পর্যন্ত ক্রিস্তিনা (ক্রিস্টিনা) ঠিক হল।   ৯ ডিসেম্বর ক্রিস্টিনা এল আমাদের ঘরে। সেই সময় আমরা একটা কটেজে থাকতাম। দোতলা এই কটেজে আমরা এক তলায়, এক জার্মান ভদ্রলোক, দুবনার জার্মান ডায়াস্পোরার সভাপতি দোতলায়। প্রথম থেকেই আমার মত একজন রঙিন মানুষ তার সাথে একই কটেজে থাকবে সেটা তার ভালো লাগেনি। তাই সে বিভিন্ন ভাবে আমাকে চাকরীচ্যুত করতে উঠেপড়ে লাগে। যেদিন আমার কন্ত্রাক্ট রিনিউয়ালের মিটিং সেদিনই ক্রিস্টিনা জন্ম নেয়। আমার কন্ট্রাক্ট এক বছরের পরিবর্তে চার মাসের জন্য বাড়ানো হয় মূলত এই কারণে। সেদিন সকাল বেলায় গুলিয়া প্রসব বেদনা অনুভব করাতে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই নদীর অন্য পাড়ে হাসপাতালে। বিকেলে  গুলিয়া ফোন করে জানায় বেলা পাঁচটায় ক্রিস্টিনার জন্মের কথা।    

সেই ক্রিস্টিনা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। নিজেই নিজের মত করে সব করে। ছোটবেলা থেকে মিউজিকের প্রতি আগ্রহ। পিয়ানো শিখতে শুরু করে ৫ বছর বয়সে। একদিন মিউজিক স্কুলে  এক ঘরে বেহালা শুনে এত পছন্দ হয় যে আমাদের না বলেই ও শিক্ষকের সাথে কথা বলে ভাইওলিন শিখবে বলে জানিয়ে দেয়। এরপর গিটার, জ্যাজ, ভোকাল। স্কুলে নবম শ্রেনীর পরেই নিজের উদ্যোগে ভর্তি হয় মিউজিক কলেজে। শেষ করে গাইতে শুরু করে বিভিন্ন গির্জায় আর কালেক্টিভে। মাঝে বছর দুই সভেশ্নিকভ করাস নামে এদেশের এক নাম করা কালেক্টিভে গান গেয়েছে। ওদের সাথে বলশয় থিয়েটার, ক্রেমলিনসহ মস্কোর বিভিন্ন ফিয়েটারে আর মঞ্চে  বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের সাথেও গেয়েছে। পুতিন, কিরিল এদের সামনেও গেয়েছে অনেকবার। কিছুদিন আগে ওটা ছেঁড়ে দিয়েছে। এখন মাঝে মধ্যে গায় বিভিন্ন গির্জায় তবে পছন্দ করে শেষকৃত্যে, বিশেষ করে যাকে বলে আভতরিতেতদের (দস্যু সর্দারদের)। তাতে নাকি পয়সা দেয় অনেক। এখন মাথায় চেপেছে গিতিজে ভর্তি হবে - অভিনেত্রী হবে। এবার পরীক্ষা দিয়ে চাঞ্চ পেয়েছিল, সময় মত ডকুমেন্ট জামা না দেওয়ায় ট্রেন মিস। শেষ দিন আমাকে ফোন করে বলল তিন ঘণ্টার মধ্যে কাগজপত্র জমা দিতে হবে। ছবি তুলে পাঠাল, আমি সেগুলো দ্রুত এডিট করে অন্যান্য ডকুমেন্ট রেডি করে পাঠালাম, তবে শেষ রক্ষা হয়নি। এ নিয়ে ওর তেমন কষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এখন অসি চালানো শিখছে। মন চাইলো কয়েকজন বন্ধু মিলে মস্কোর মেট্রোতে নেমে গেল গিটার, ভায়োলিন এসব নিয়ে। ঘরে থাকলে হঠাৎ রাতের বেলায় শুরু করল কোন আরিয়া (ক্ল্যাসিকাল ভোকাল)। আমার নিজেরই ভয় হয় প্রতিবেশিরা ছুটে আসে কখন। এক কথায় আমার মতই ড্যাম কেয়ার ভাব। আমি ওদের কখনও কোন ব্যাপারে জোর করিনি। একটাই বলেছি, তোমরা যে কাজ করে মনে শান্তি পাও সেটাই করার চেষ্টা কর, বেতন নয় কাজ করার আনন্দে কাজ কর। আমি যতদিন পারি তোমাদের পাশে আছি। দেখা যাক আমার দেওয়া স্বাধীনতা ওদের বিকশিত হতে সাহায্য করা কিনা। জীবন একটা বিশাল ল্যাবরেটরি। সব পরীক্ষা যে সফল হবে তার মানে নেই, তাই পরীক্ষাটা যদি উপভোগ করা যায় - সেটা অনেক কিছুই পুষিয়ে দেয়। ফিজিক্সে বলে নেগেটিভ রেজাল্ট সেটাও রেজাল্ট। 

দুবনা, ১০ ডিসেম্বর ২০২০ 



 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি