নকল জীবন


গতকাল এক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলাম কার লেখা নকলের কথা। নকল ব্যাপারটা বরাবরই খারাপ চোখে দেখতাম। নকল যদিও বিভিন্ন বিষয়েই হয়, এমনকি নকল করে গান গাওয়া বা অভিনয় করা শিল্প জগতের একটা ধারা, জিঞ্জিরায় অনেক কিছুই নকল করে তৈরি করা হয় তবে সাধারণত নকল বলতে আমরা আগে পরীক্ষার হলে দেখে লেখাটাই বুঝতাম। ধারণা করা হত শুধু খারাপ ছাত্ররা নকল করে। এখনও মনে আছে, এইচ এস সি পরীক্ষার কথা। ওখানে আমার চতুর্থ বিষয় ছিল বায়োলজি। সাধারণত প্রাক্টিক্যালে কমবেশি ভালো ছাত্রদের ভাল নম্বর দেওয়া হয়। ওখানে দেখি দশ টাকা করে নিচ্ছে সবার কাছ থেকে উত্তর বলে দেবে বলে। টাকাটা ফ্যাক্টর ছিল না, কিন্তু টাকা দিয়ে উত্তর জানা মানে নকল করা। এটা মেনে নিতে পারিনি। ফলে দুটো প্র্যাক্টিকালে ১৩ করে (পাস মার্ক), স্টার মার্ক হাতছাড়া। ওটা না হলে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে আমিই হতাম প্রথম স্টার মার্ক পাওয়া। যদিও পরবর্তী জীবনে এর কোনই গুরুত্ব ছিল না, বললাম নকলের প্রতি নিজের মনোভাবের কথা বলতে গিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে নকলের প্রশ্ন আসেনি আর তৃতীয় বর্ষ থেকে আমাদের বই খাতা সব কিছু ব্যবহার করতে দিতেন শিক্ষকগন, যেটা আমি নিজেও করি। তবে শর্ত একটাই - উত্তর দিতে বসলে আর কিছু দেখা যাবে না আর পরীক্ষা হবে সারা বছরের যা পড়ান হয়েছে সব, মানে প্রশ্ন পত্র বলে ব্যাপার থাকবে না, হবে ইন্টারভিউ। আমি যখন পিএইচডি কমপ্লিট করার পথে তখন আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা ঘটনা ঘটে। তখন চাইলেও এখনকার মত সহজে রিসার্চ পেপার পাওয়া যেত না। এক ছেলে কীভাবে কীভাবে সেসব ম্যানেজ করে থিসিস লেখে। যার কাজ সে নকল করে সে ছিল এই ছেলের সুপারভাইজারের ছাত্র, তখন স্পেনে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াত। স্বাভাবিক ভাবেই থিসিস জমা দেওয়ার আগে সেটা ওর চোখে পড়ে। এ নিয়ে অনেক হৈচৈ। থিসিস আর ডিফেণ্ড করা হয় না। বর্তমানে প্রায় সব জার্নালই এ ব্যাপারে সচেষ্ট। ফলে কোন পেপার সাবমিট করার সময় আন্টিপ্লাগিয়াত মেমারেণ্ডমে সই করতে হয়। একবার আমার এক লেখা ঘুরিয়ে দিল সেখানে প্রায় ৩০% আমার আগের আরেকটা লেখা থেকে নেওয়া ছিল বলে। আমি মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে লিখি, এমন হয় একটা লেখা শেষ না করে বাসায় ফিরলাম। এসে দেখি ওটা পেন ড্রাইভে আনা হয়নি। নতুন করে লিখি। দেখা যায় দুটো লেখার ভাষা একেবারেই ভিন্ন। হয়তো আবেগের ওঠানামার কারণে। কিন্তু পদার্থবিদ্যার রিসার্চ পেপার যেখানে ৬০% - ৭০% ফর্মুলা, কপি পেস্ট না করলেও অনেক কিছুই রিপিট হয়ে যায়। ওখানে সাহিত্য করার সুযোগ নেই। তারপরেও এখন চেষ্টা করি ভিন্ন ভাবে বলার, ভিন্ন ভাবে লেখার। ছাত্ররা যখন থিসিস লেখে ওদের এই আন্টিপ্লাগিয়াত টেস্ট দিতে হয়। যাহোক এসব কথা অপ্রাসঙ্গিক। আসল ঘটনা গতকালের স্ট্যাটাস। আমার মনে হয় এটা এক সর্বগ্রাসী সমস্যা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ইনবক্স ভরে গেছে সুপ্রভাতে (সত্যি বলতে ওরা আসতে শুরু করে রাত দুপুর থেকেই)। এসবের ৯৯% হয় কপি পেস্ট না হয় ধার করা কার্ড। আর এসব করছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। যারা আজ আর নিজেরা ভাবতে চায় না, জন্মদিন থেকে শুরু করে যে কোন বিষয়েই নেট থেকে পছন্দের একটা লেখা নিয়ে পাঠিয়ে দেয়। একই ঘটনা অনেকে ঘটায় যখন বিবাহ বার্ষিকীতে নিজেদের প্রেমের কথা জানাতে চায়। কেউ এখন নিজের মুখ দিয়ে ভালবাসি কথাটা পর্যন্ত বলতে পারে না বা চায় না। ধার করা টেক্সট পোস্ট করে। সেটা বলে বাবা মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, কারও মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আমরা অভিযোগ করতাম যে রাস্ট্র আমাদের হয়ে সব ভেবে রেখেছে। আমি কোথায় পড়ব, কী পড়ব ও পরব, কোথায় চাকরি করব - সব। এখন আমাদের জোর করে এটা করায় না, তবে সারাদিন আমাদের চারিদিকে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় যে দরকার হোক আর না হোক আমার এই মোবাইল ফোন, ঐ গাড়ি আর সেই পোশাকটা কিনতেই হবে আর যদি কিনতে নাও চাই তার প্রশংসা বাণী আমাকে শুনতেই হবে। সোভিয়েত আমলের জবরদস্তির নীতির বদলে সুক্ষ ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভোগবাদের তত্ত্ব। অথবা বলা যায় জিন্নাহর মত ভাষণ আর অস্ত্রের মুখে উর্দু শেখানোর পরিবর্তে সিনেমার মাধ্যমে হিন্দি শিখিয়ে। ফেসবুক খুলে দেখব সবাই খেলায় মেতে উঠেছে। কেউ জানতে চাইছে পূর্ব জন্মে সে কে ছিল (আচ্ছা পূর্বজন্ম কি হালাল?), কেউ জানতে চাইছে দশ পনের বা বিশ বছর পরে সে কেমন দেখতে হবে। না না, এতে দোষের কিছু নেই। অধিকাংশ মানুষের কাছেই এটা ফান। কিন্তু যেসব মানুষের আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে, যাদের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে অন্যের স্বীকৃতির উপর তারা এটাকে সিরিয়াসলি নিলে নিতেও পারে। এক কথায় আমরা সবাই নিজেরা নিজেদের যেভাবে ম্যানিপুলেট করতে দিচ্ছি তাতে কিছুদিন পরে নিজেরাই তো প্লাগিয়াত হয়ে যাব। আমাদের চলা, বলা, খাওয়া, পরা, ভাবা - সবই তো হবে অন্যের অনুকরণ। অনেকেই নতুন জামাকাপড় পরে, হেয়ার স্টাইল বদলিয়ে আয়নায় নিজেকে খুঁজে না, খুঁজে কোন সাল্মান খান, টম ক্রুজ এদের। এটাও কি নকল নয়? শুধু কি ব্যক্তি জীবনে? আমরা দলীয় ভাবেও নিজ নিজ দেশের বৈশিষ্ট্য ভাবনায় না নিয়ে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন মুভমেন্ট অনুসরণ করে যাচ্ছি। আমরা বুঝতে চাইছি না ঘোড়ার গাড়ি চালাতে হলে ঘরাকে খাওয়াতে হবে, দামী ব্র্যাণ্ডের পেট্রোলিয়াম হবে শুধুই পয়সা আর সময়ের অপচয়। তাই শুরু করা দরকার নিজের থেকে। আমরা এক দিকে স্বাধীনতার কথা বলছি, অন্য দিকে প্রতি পদে পদে নিজেদের ম্যানিপুলেট করতে দিচ্ছি। আগে সামন্তরা ছিল দাসদের শরীরের মালিক, এখন নব্য সামন্তেরা হচ্ছে আমাদের মনের মালিক। আমরা বিভিন্ন বেশে আসা শয়তানের কাছে নিজেদের আত্মা বন্ধক দিয়ে বসে আছি আর করছি সেটা সেচ্ছায়, স্বাধীন ভাবে। আসুন আমরা সব ধরণের অনুকরণ পরিহার করি। অনুকরণটা বানরদের জন্য রেখে দিই।

দুবনা, ১২ ডিসেম্বর ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি