বাতাসের দুঃখ

হলুদ বরণ সর্ষে সেদিন বলল, পদদলিত হয়েও সেদিন কাঁদিনি, রাস্তা করে দিয়েছিলাম যাতে মানুষ পালাতে পারে। আজ স্বাধীন দেশে কৃষক তার ফসলের মূল্য পায় না। কৃষকের সাথে আমরাও অবহেলিত। এটাই কি আমাদের সেদিনের কষ্টের প্রতিদান? সবুজ ধেনো মাঠ, পাট ক্ষেত বলল, নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রেখেছি। সেদিন যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের অনেকেই ঘুরে বেড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিয়। এটাই কি আমাদের স্বাধীন দেশ থেকে একমাত্র উপহার। নদীরা বলল, লাখ লাখ লাশের ভার বইতে বইতে হাপিয়ে উঠেছি। প্রয়োজনে প্রমত্ত হয়ে রুখে দিয়েছি হানাদারদের পথ। আজ জলহীন ক্ষত বিক্ষত। এটাই কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পুরষ্কার? বাতাসে ভেসে বেড়ানো নারীর কণ্ঠ বলল সত্যিকারের স্বাধীনতা পাব বলে দিনের পর দিন হানাদার ক্যাম্পে অত্যাচার সহ্য করেছি, অথচ স্বাধীন দেশে কেউ হাত বাড়ানো তো দূরের কথা, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এটাই কি ছিল আমাদের জীবন বাজী রেখে যুদ্ধের প্রতিদান? বধ্যভূমিতে প্রেতাত্মারা গুঙিয়ে গুঙিয়ে প্রশ্ন করল তাদের রক্ত দিয়ে লেখা যে সংবিধান আজকে কেন তা কালিমালিপ্ত  হল? কেন এই দেশ আজ রাজাকারদের অভয়ারণ্য? শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বললেন আটচল্লিশ থেকে শুরু করে তারা যে জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছেন দিনের পর দিন তা আজ কোথায়? কোথায় বাংলা? কোথায় বাঙ্গালী? কোথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?  কিভাবে সম্ভব যে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে যেমন জন্ম নিয়েছে মোল্লাতন্ত্র, বুদ্ধিজীবীদের থেকে জন্ম নিয়েছে বুদ্ধি দুর্বৃত্ত? আমরা তো পাকিস্তানী শোষকের জায়গায় বাংলাদেশী শোষকের জন্য যুদ্ধ করিনি, আমরা তো পাকিস্তানের নির্যাতিত জনতাকে বাংলাদেশের নির্যাতিত জনতা হিসেবে দেখতে চাইনি। আমাদের যুদ্ধ ছিল এই শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, আমাদের যুদ্ধ ছিল অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য, ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, মানবিক সামাজের জন্য, সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য। সে ছিল এক বহুমুখী পরিকল্পনা। আমরা কি আজ সে লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছি নাকি অর্থের ঝলসানি দেখে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছি? আমাদের মূল লক্ষ্য তো ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পতাকায় সবাইকে এক করা। কিন্তু আজ আমরা কোথায়? আমরা এখন শুধু দ্বিজাতি তত্ত্বের পৃষ্ঠপোষকই নই, আমরা জাতিকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে অনু পরমানুতে পরিণত করছি। বাঙ্গালী নয়, মুসলমান - এটাই হতে যাচ্ছে আমাদের প্রধান পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মাদ্রাসাই আজ তৈরি করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ধর্মের বাণী নয় টুপি দাড়ি, মুজিবের আদর্শ নয় - মুজিব কোট, শিক্ষা নয় - ডিগ্রী, একাত্তরের চেতনা নয় - একাত্তর নিয়ে গলাবাজি - এসবই হয়ে উঠেছে আজ আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। এখন আমরা যতটা না বাংলা ভাষার সঠিক চর্চার কথা বলি তাঁর চেয়ে বেশি মেতে থাকি একুশের বইমেলা আর পদক নিয়ে, মহা আড়ম্বরে বিজয় দিবস পালন করলেও ভুলে যাই বিজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের সংবিধানের কথা। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ - এসব আজ নিষিদ্ধ প্রায় শব্দসমূহ। আর কতটা পিছু হটলে বাঙ্গালী সত্যিকারের মুসলমান হবে,  সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলা আরবের মরুভূমি হবে?  এরকম অগনিত প্রশ্ন, অগনিত দীর্ঘশ্বাস আজ ভেসে বেড়াচ্ছে বাংলার আকাশে বাতাসে। 

দুবনা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ 




     



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি