ভাস্কর্যের বিমূর্ত মূর্তি

 

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি আর আমার সহকর্মী ভিক্টর একটা প্রব্লেম নিয়ে কথা বলছি চা খেতে খেতে। হঠাৎ বিবিসিতে একটা নিউজ দেখলাম। ঐ সময় আমি দুটো সাইট রেগুলার দেখতাম – ক্রিক ইনফো আর বিবিসি। ওটা ছিল মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন কেরির মন্তব্য – আসাদ রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংস করলে আমেরিকা তাঁর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা এমনই ছিল। আমি ভিক্টরকে বললাম আসাদের জন্য এ যে উইন উইন সিচুয়েশন।  কেন? দেখ, আজকের বিশ্বে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে কেউ পার পায় না। আর যা ব্যবহার করা যায় না সেটা রাখা তো হাতি পালা। এর রক্ষণাবেক্ষণে যে খরচ তাতে এক বিশাল আর্মি পোষা যায়। তাছাড়া যতদিন এটা সিরিয়ার কাছে থাকবে ততদিন এমনকি ব্যবহার না করেও সে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে। তাই এখন তার উচিৎ আমেরিকা বা আন্তর্জাতিক কমিউনিটির পয়সায় এই অস্ত্র থেকে মুক্ত হওয়া। বোনাস হিসেবে এই মুহূর্তে আমেরিকার খপ্পর থেকে সাময়িক ভাবে রক্ষা পাওয়া গেলে যেতেও পারে।  আমার বিশ্বাস এটা শুধু আমিই না অনেকেই ভেবেছিলেন, বিশেষ করে রুশ গেনস্তাব। ফলাফল আজ আমরা সবাই জানি। প্রশ্ন হল, কেন আজ এ কথা বলা?

যেকোন ঘটনাই ঘটুক না কেন, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে মানুষ প্রথমে বেনিফিসিয়ারি খুঁজে। এখন দেশে মূর্তি আর ভাস্কর্য প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রমাণ করতে এই বাংলায় কে হালাল আর কে হারাম। আমরাও সেই বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছি। আর প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের হাই কম্যান্ড অন্তর্যামীর মত সেটা দেখে হাসছেন। কেন?  শুনেছি পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে গৃহবন্দী সম্রাট শাহজাহান আগ্রা দুর্গ থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমার তো মনে হয় আমাদের গণতন্ত্র তার মানস কন্যার পিতৃ স্নেহে আবদ্ধ হয়ে একই ভাবে রাজপ্রাসাদে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। আর বিরোধী দল নামক অবাধ্য সন্তানরাও গণতন্ত্রের কুম্ভকর্ণের ঘুম কিছুতেই ভাঙ্গাতে পারছে না। সরকারি দলের সক্রিয় সহযোগিতায় বিএনপি শীত নিদ্রায়। সিপিবির মত বামপন্থী দলগুলোর পালে হাওয়া নেই অনেক দিনই, এখন ছাত্র লীগ, যুব লীগের কল্যাণে পায়ের নীচে মাটিও সরে যাচ্ছে দিন দিন। অর্থাৎ রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আইসিইউতে। এমতাবস্থায় হেফাজতের মিটিং মিছিল সরকারের জন্য বসন্তের বাতাসের মত। একদিকে এটা মৃতপ্রায় গণতন্ত্র যে এখনও একটু একটু করে হলেও শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে সেটা প্রমাণ করে, অন্য দিকে আওয়ামী লীগ না হলে মৌলবাদ ক্ষমতায় আসবে – বহির্বিশ্বকে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যায়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে সরকার, সরকারি দল একমাত্র না হলেও বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান বেনিফিসিয়ারি। হয়তো এ কারণেই অনেকেই ভাবছেন ভাস্কর কাণ্ডে আওয়ামী লীগের হাত না থাকলেও মৌন সম্মতি আছে। তবে নাটক যেভাবে গড়াচ্ছে, বিশেষ করে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ক্ষতিগ্রস্থ করার পর অনেক হিসেবেই গড়মিল দেখা দিচ্ছে। চট্টগ্রামে ছাত্র লীগের ভুমিকায় অনেকেই আশাবাদী হয়ে ভেবেছিল কুষ্টিয়ার পর সরকার শক্ত হাতে এসব দমন করবে। তবে আওয়ামী লীগের হাই কম্যান্ডের নরম, আপোষকামী সুর সে রকম ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এ ঘটনাকে অনেক মন্ত্রী বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে বলেছেন। এর অর্থ কি এই নয় যে সরকারি দলের একটা অংশ রাজনৈতিক মঞ্চ একটু হলেও চাঙ্গা করার জন্য এসব ভেতরে ভেতরে উস্কে দিচ্ছে?

আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারি না। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কথা বলে, জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে ক্ষমতায় আসে আর ক্ষমতায় এসেই জনগণের কথা বেমালুম ভুলে যায়।  এটা মনে হয় সব দেশের সরকারি দলের এক ধরণের পারকিন্সন রোগ। ধরুন দেশের মানুষ কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য দাবী করছে, শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক দাবী করছে। সরকার কি সেটা মেনে নিচ্ছে? না। বরং পারলে আন্দোলনরত শ্রমিক, কৃষকের বিরুদ্ধে পুলিশ আর দলীয় গুন্ডা লাগাচ্ছে। যদিও সরকার এসব দাবি দাওয়া মানতে সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ। এসব দাবি মানা মানে সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আবার এই সরকারই হেফাজতের দাবির মুখে দেশের সূর্য সন্তানদের ভাস্কর্য সরাচ্ছে, পাঠ্যপুস্তক থেকে সেকুলার লেখকদের রচনা বাদ দিচ্ছে যদিও সেটা অসাংবিধানিক। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না দেশের জন্মই হয়েছিল ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে, দ্বিজাতি তত্ত্বকে অস্বীকার করে – হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান আমরা সবাই বাঙালি – এই চেতনাকে বক্ষে ধারণ করে।  যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল করছে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো তাদের উপর হামলা করছে সরকারি দল। কেন? তারা কি ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত? সে অভিযোগ কেউ করছে না, যদিও করাই যেত। কেননা বিশ্বাস করুন আর নাই করুন এই মুহূর্তে এরাই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের জনগণকে, একাত্তরের চেতনাকে নির্মম ভাবে ধর্ষণ করছে।     

আমার কেন যেন মনে হয় এখনই সুযোগ, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে যে বিতণ্ডা তৈরি হয়েছে তাঁকে পুঁজি করে রুখে দাঁড়ানোর। আর সেটা করতে হলে ভাস্কর্য আর মূর্তির বিতণ্ডা বাদ দিতে হবে। ইসলামে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ হলেও  অন্য ধর্মে তা নয়। তাই মূর্তিকে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে আমরা প্রকারান্তরে জনগণের একটা অংশের নাগরিক অধিকারকেই অস্বীকার করব, নিজেদের দ্বিজাতি তত্ত্বের নাগপাশে আবদ্ধ করব। তাই মূর্তি আর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক করাটা একদিন ব্যুমেরাং হয়ে আসতে পারে।

ছোটবেলায় অনেকের মত আমিও ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করতাম। যুদ্ধের সময় প্রতিদিন কলার ডগা দিয়ে কালীমূর্তি বানিয়ে পূজা করতাম আর প্রসাদ হিসেবে দেওয়া এক মুঠো চাল একটা কৌটায় উঠিয়ে রাখতাম। একদিন আমরা যেখানে পালিয়ে ছিলাম সে বাড়িতে যখন রাজাকার পড়ে আর সব কিছু নিয়ে যায়, চকির নীচে রাখা সেই চাল দিয়ে সবার রাতের খাবার  ব্যবস্থা করা হয়। পরে সময়ের সাথে অনেক কিছুর মত ঈশ্বরকে ত্যাগ করি। সেই অবিশ্বাস নিয়েই এক সময় আসি মস্কো, পড়াশুনা করতে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে লেনিনের ভাস্কর্য দেখে অবাক হয়ে ভাবি ইন্ডিয়ায়ও এত শিব লিঙ্গ নেই যত লেনিনের মূর্তি আছে সোভিয়েত দেশের আনাচে কানাচে। এরপর একদিন আমার রুম মেট বলল সে যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করত লেনিন হত তার ঈশ্বর। আমার মনে হল ইসলাম নয়, সাম্যবাদই হচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্ম। এখানেও ধর্মের মতই সব কিছুই ডগমায় পরিণত হচ্ছে।  লেনিনও আজ পূজিত হচ্ছেন যেমনটা হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ যদিও নিজে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না। মূর্তি থাকুক আর নাই থাকুক, কাউকে যখন অন্ধভাবে বিশ্বাস করা হয়, তিনি অশরীরী দেবতায় পরিণত হন, পূজিত হন। নিজদের চারিদিকে তাকালে কী দেখব? নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা - এক কথায় যারই একটু ক্ষমতা আছে, এমন কি সে যদি গ্রামের চৌকিদারও হয়, সবাই তার অধীনস্ত মানুষের কাছে দেবতা তুল্য হতে চায়, অন্যদের কাছ থেকে পূজা পেতে চায়, অনেকে ঘুষ হিসেবে সেটা পায়ও। নিজেরা পূজা নিতে আপত্তি করবেন না অথচ মানুষ মূর্তির আঁকারে কোন অদৃশ্য দেবতাকে পূজা করলে ফতোয়া জারি করবেন – সেটা কি অধর্ম নয়? তাই মূর্তি, ভাস্কর্য – এসব কোন ইস্যু নয়। ইস্যু কী? ইস্যু ধর্ষণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে ভিন্ন মতের মানুষের নাগরিক অধিকার হরণ, ইস্যু ধর্মের নামে বাংলা ভাষার, বাংলা সংস্কৃতির উপর বাধানিষেধ আরোপ এসব। ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশের ভিত্তিই হল বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার মানুষ, এদেশের বাউল গান, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি। এর যেকোনোটার আঘাত – সংবিধানের উপর আঘাত, একাত্তরের চেতনার উপর আঘাত, দেশের অস্তিত্বের উপর আঘাত। তাই আজ ভাস্কর্য আর মূর্তি রক্ষার সংগ্রাম ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মতই। আর এটা করার দায়িত্ব সমস্ত রাজনৈতিক আর সামাজিক সংগঠনের।  আর এখানেই সুযোগ দেশে সুস্থ্য রাজনীতি ফিরিয়ে আনার। আজ যদি বিভিন্ন বিরোধী দল, এমনকি বিএনপি বঙ্গবন্ধুর সহ সমস্ত ভাস্কর্য আর মূর্তি রক্ষার সংগ্রামে নামে তাহলে সেটা শুধু তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনই হবে না, সেটা হবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। বিভিন্ন ইস্যুতে এসব দলের মিটিং মিছিলে সরকারি দল আক্রমণ করলেও এই মুহূর্তে সেটা করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে, কেননা  মুখে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বলে তাঁর ভাস্কর্য রক্ষার পক্ষে মিটিং মিছিলে হামলা করলে তাদের মুখোশ খুলে পড়বে। সেদিক থেকে এই ইস্যু হবে বিরোধী দলের এক ট্যাক্টিক্যাল পদক্ষেপ আর সরকারি দলের জন্য লিটমাস টেস্ট।

দুবনা, ০৭ ডিসেম্বর ২০২০






Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি