আমাদের সময়


এবার জন্মদিনের চাপটা বেশি থাকায় ঘরে শুয়ে বসে কাটিয়েছি। পরের দুদিন মানে শনিবার আর রবিবার একটু ভালো গেলেও রবিবার রাতে আবার প্রেসারের মেজাজ খারাপ। সোমবার সকালে প্রতিদিনের মত গেলাম ইঞ্জেকশন নিতে। ওদিন আবার ইসিজি করার কথা ছিল, কি একটা নাকি সমস্যা আছে, আমার বিশাল হৃদয় নাকি সংকুচিত হয়েছে। বর্তমানে মহাবিশ্ব যখন ত্বরিৎ গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে, আমার হৃদয়ের এ অবস্থা প্রকৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ। তাই ইসিজি। এর মধ্যে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হল্টার করার। হৃদপিণ্ডের চারদিকে একগাদা তার সেঁটে কোমরে একটা ডিভাইস ঝুলিয়ে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। বললেন যা যা করি সব কিছু লিখে রাখতে। বুঝলাম ভালবাসা ভালবাসা খেলা আজ আর চলবে না। বাসায় অবশ্য কিছুই বলিনি। সন্ধ্যায় ফ্যামিলি গ্রুপে একটু ঝড় উঠল। সেভা ২৪ তারিখ রাতে এসে ২৭ তারিখে মস্কো ফিরেছে। ওরা কেউ যখন বাইরে বেড়াতে যায়, ফিরে এসে অন্যদের উপর এক হাত নেয় এই বলে যে তার অনুপস্থিতিতে অন্যেরা ঘর দুয়ার নোংরা করেছে। সেভা এ ব্যাপারে কাউকে তোয়াক্কা করে না। লিখল, "তোমরা সব গাধা নাকি যে নিজেদের ময়লা পরিস্কার করতে পার না?" এরপর এক এক করে মনিকা, ক্রিস্টিনা, আন্তন, গুলিয়া সবাই লিখতে শুরু করলে। মনিকার ফোন এলো "তুমি সেভাকে শাসন করতে পার না? আমরা সবাই কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। ও সারাদিন ঘরে বসে কম্পিউটারে গেম খেলে। একটু পরিষ্কার করলে কী হয়? তুমি ওকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দাও। কাজ করুক।" আমি এসব ব্যাপারে নাক গলাতে চাই না। হাসি। "তুমি সারা জীবন শুধু হেসেই গেলে। ওকে বল কিছু। নইলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে।" "ঠিক আছে, দেখি।" সেভাকে ফোন করলাম।" "তুই কিন্তু ঘর পরিষ্কার করার জন্য প্রতি সপ্তাহে আমার কাছ থেকে এক্সট্রা টাকা নিস। নিজেই চেয়েছিস। পরিষ্কার করতে পারিস না?" সেভা ফোন ছেঁড়ে দিয়ে আমাকে মেসেজ করতে শুরু করল। মিনিটে মিনিটে তার ধাক্কায় আমার পড়ে যাওয়ার অবস্থা। প্রায় সবই যৌক্তিক। আসলে সেভা অনেকটা আমার মত, এমনকি খারাপ কিছু করলেও তার পেছনে শক্ত যুক্তি দাড় করায়। উপায় না দেখে আমি ওদের আবেগের জায়গায় আঘাত করলাম। খালি গায়ে নিজের একটা ছবি পাঠিয়ে লিখলাম, আমার এখন কোন মতেই উত্তেজিত হওয়া নিষেধ। এখন চুপ কর সবাই। পাশের ঘর থেকে গুলিয়া জিজ্ঞেস করল "এটা কী?" ওদিকে অন্যেরাও চুপচাপ। মনিকা ফোন করে বলল সেভার সাথে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলেছে।  গলা শুনে বুঝলাম চোখে এক পশলা বৃষ্টি বয়ে গেছে।     

মঙ্গলবার সকালে গেলাম আবার ইঞ্জেকশন নিতে। আজই শেষ দিন। তাই যারা ইঞ্জেকশন দেয়, ফিজিও থেরাপি, ম্যাসেজ, জিম্ন্যাটিক্সে সাহায্য করে, নববর্ষের প্রাক্কালে সবার জন্য চকলেট নিয়ে গেলাম, আর ডাক্তারের জন্য একটা বড় প্যাকেট। হল্টার খুলে বাকি সব করলাম। ডাক্তার বললেন আমি যেন হল্টারের রেজাল্ট নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করি।  ঘন্টা খানেক বসে থাকার পর রেজাল্ট পেয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। উনি আসলে নিউরোলজিস্ট। আমার সমস্যা যেহেতু মূলত ঘাড়ের স্পন্ডেলাইলিস থেকে হয় তাই সাধারণত রেগুলার উনিই আমাকে দেখেন। মাঝে মঝে কারডিওলজিস্ট। উনি সব দেখে বললেন, একটু বসুন, আমি কারডিওলজিস্টের সাথে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। উনি নিজেই কথা বললেন। একটু পরে কারডিওলজিস্ট আমাকে ডাকলেন। উনি গত বছর আমার চার্জে ছিলেন। বললেন, "কিছু সমস্যা আছে। তবে আমরা এই মুহূর্তে ঠিক বলতে পারছি না কিছু টেস্ট না করে। এই মাত্র একজনকে আমি সেই টেস্টের জন্য পাঠালাম। আপনি চাইলে ওর সাথে পাঠিয়ে দিতে পারি। এখন ইমারজেন্সির সব গাড়ি কোভিড নিয়ে ব্যস্ত। ওদের অপেক্ষা করলে অনেক দেরী হতে পারে।" আমি বললাম, "সেটা সমস্যা নয়। কিন্তু যেতে হবে কোথায়? সামনে নববর্ষ। হুট করে তো চলে যাওয়া যায় না। বাসায় কনসাল্ট করা দরকার।" "যেতে হবে দ্মিত্রভ কারডিওভাস্কুলার সেন্টারে। আমাদের হেড ওখানে ফোন করেছেন। তারা রাজী আছে। এখন তো বেশ কষ্ট এসব করা। আপনি চলে যান। দেরী করার সময় নেই। তেমন কিছু নয়। একটা চেকাপ। সময় হারানো ঠিক হবে না।" "ঠিক আছে। আমি তাহলে বাসায় গিয়ে রেডি হই। বন্ধুদের কাউকে বলে দেখি পৌঁছে দিতে পারবে কিনা? কিন্তু ক দিন থাকতে হবে?" "দু দিনও হতে পারে আবার সাত দিনও। হল্টারের রিপোর্ট বলছে গত রাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২১ মিনিট আপনার রক্তচলাচল বন্ধ ছিল। আপনি সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নেবেন বলেই আশা করছি।" আমি বাসায় চলে গেলাম। জানি সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে গুলিয়াকে কনভিন্স করা। ওর ধারণা আমার সব সমস্যা বেশি বেশি ডাক্তারের কথা শোনা। আমি বলি, "দেখ যদি ফিজিক্সের সমস্যা হত আমি ভাবতাম। শরীরের সমস্যা দেখার জন্যই ডাক্তার। ওদের কাজ ওরাই করুক।" যা ভেবেছিলাম, গুলিয়াকে বলাতেই ওর মুখে কালো মেঘ নেমে এলো। আমি আবার বললাম, "দেখো, অসুখ বিসুখ, এটা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর লড়াইটাও একান্তই একার। আমি মানুষকে বিশ্বাস করি, বিজ্ঞানে বিশ্বাস করি। জানি ডাক্তার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে আমার সমস্যা সমাধানে। আর আমিও নিজেকে বলতে পারব, সমস্যা সমাধানে কোন গাফিলতি করিনি। আমি যাচ্ছি।" গুলিয়া জানে এরপর আর কথা চলবে না। ছেলেমেয়েদের ব্যাপার হলে হয়তো ভগবানকে ডাকার চেষ্টা করত।  জানে আমি প্রার্থনা, দোয়া, এসবে বিশ্বাস করি না, বরং যারপর নাই বিরক্ত হই, এমনকি এসব বলায় অনেক সময় লোকজনের সাথে সম্পর্ক কাট আপ করি। কেননা আমার সমস্যায় ঈশ্বরকে ডাকা মানে মানে আমার উপর আস্থা না রাখা। আমি যে নিজেই লড়াইটা করতে পারি, ডাক্তার আর বিজ্ঞান আমার পাশে দাঁড়াতে পারে - সেই বিশ্বাস যারা না রাখে তারা আর যাই হোক আমার বন্ধু হতে পারে না। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে ফোন করল। ওরা কাগজপত্র রেডি করে বসে আছে। দেমিদ বা পলিনাকে না পেয়ে ফটোগ্রাফার বন্ধু নিকোলাইকে ফোন করলাম। ও রাজী হল। আসলে ট্যাক্সি করেই যাওয়া যেত আর বিলটা ইনস্টিটিউটে সাবমিট করা যেত, তবে পরিচিত লোক থাকলে সুবিধা। যাহোক, শেষ পর্যন্ত দ্মিত্রভ গিয়ে পৌঁছলাম। এটা দুবনা আর মস্কোর ঠিক মাঝপথে। পুরান শহর। ১১৪৭ সালে ইউরি দল্গরুকি মস্কো প্রতিষ্ঠা করেন আর ১১৫৪ সালে স্থাপন করেন দ্মিত্রভ। এর আগে দুবার এসেছি এ শহরে। আমাদের ছবি প্রদর্শনীতে।  বেশ খড়কুটো পুড়িয়ে সেন্টার খুঁজে পেলাম। এটাকে স্থানীয় লোকজন চেনে কারডিওলজি হিসেবে। যাহোক, খুঁজে পেয়ে নিকলাইওকে বলে দিলাম চলে যেতে।  আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন একজন ডাক্তার। এরপর এলেন ওখানকার প্রধান। "কী সমস্যা?" ব্যাখ্যা করে বলতে গেলে বললেন "দেখুন, এখানে আমরা শুধু কারডিওলজির সমস্যা নিয়ে কথা বলব। এখানে আমরা আপনার করনারিগ্রাফি আর এঞ্জিওগ্রাম করব। যদি কোন সমস্যা দেখি সাথে সাথে অপারেশন। সেটা রক্তনালীতে স্ট্যাণ্ড বসানোও হতে পারে আবার হার্ট সার্জারি হতে পারে। যদি রাজী হন, কাগজপত্রে সই করেন। না হলে বাসায় ফিরে যান। সব অপারেশনই কমবেশি রিস্কি। সিদ্ধান্ত আপনার।" "আমি কি একটু ভাবতে পারি?" "বড়জোর পাঁচ মিনিট। আমাদের এখানে অনবরত রোগী আসছে। বসে থাকার সময় নেই।" এই প্রথম বুঝতে পারলাম এটার গুরুত্ব। একবার মনে হল গুলিয়াকে ফোন করি। পরে ভাবলাম ওখানে ফোন করা মানেই পিছুটান। স্বপনদা ডাক্তার। ওকে ফোন করেছিলাম। তখন ধরেনি, মেসেজ রেখেছিলাম। এ সময় ও নিজেই ফোন করল। সব শুনে বলল, চেকআপটা করিয়ে নেওয়াই ভালো। এরপর ডাক্তারকে বললাম, "আমি রেডি।"  

এরপর শুরু হল প্রস্তুতি পর্ব। এখানে হাসপাতালে অধিকাংশ ডাক্তার নার্সই মেয়ে। আমাকে ঘিরে ধরল একদল বিভিন্ন বয়সী মহিলা। জেনে নিল আমি রুশ বলি কিনা। হ্যাঁ বোধক উত্তর শুনে ওরা এক দিকে যেমন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, অন্যদিকে শুরু হল ঠাট্টা মস্করা। "ওহে চকলেট বালক, তুমি কি জান, তোমাকে ন্যংটো হতে হবে?" আমি ভাবলাম, বরাবর যেমনটা হয়, শার্ট খুলতে হবে। জ্যাকেট, জুতা আগেই খুলে রেখেছি পাশে। এবার সোয়েটার খুললাম। আমি শার্ট পরিনা। উলের শার্ট কাম সোয়েটার পরি। "প্যান্ট, মজা এসব খুলতে হবে।" শোনা গেল উৎসুক কণ্ঠ। খুলে বসে আছি। "এখন আন্ডারপ্যান্ট।" আমার এ নিয়ে তেমন সমস্যা নেই, তবে ভাবছি, এরা নিশ্চয়ই মস্করা করছে। যাহোক সেটাও খুলে ফেললাম। "এবার শুয়ে পড়।" এরপর একজন এলেন সেভিং ক্রিম আর রেজার নিয়ে। "চুপ করে শুয়ে থাক। উনি আমার অণ্ডকোষের চারপাশে রেজার চালালেন।" এরপর আমাকে ঢেকে বেডটা ঠেলে নিয়ে গেলেন অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ওখানে অন্য দুই মেয়ে এসে আমাকে শিফট করলেন আরেকটা বেডে। এরপর অপারেশন থিয়েটারে এসে আবার অন্য বেডে। দেখেই বুঝলাম এখানে টেস্ট হবে। এবার এলেন এক ছেলে ডাক্তার। "সাহা বিজন? কী নামে ডাকব আপনাকে?" "বিজন।" "বিজন, আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি এসময়টা সজ্ঞানে থাকবেন। মাঝে মধ্যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। যদি কখনও সহ্য করা কষ্ট হয়, আমাকে মুখে বলবেন।" উনি আমার সাথে অনবরত কথা বলছিলেন। আমারও যখন যদি তুলি, মডেলের সাথ অনবরত কথা বলি, যাতে সে রিল্যাক্স মুডে থাকে। মনে হল এটাও তাই। কোন দেশ থেকে এসেছি। কোথায় পড়াশুনা করেছি। এখন কী করি। মাঝে মধ্যে দু একটা প্রশংসামূলক শব্দ ইত্যাদি। "এখন আমি হাতটা একটু কাটব। অনেকটা সুই ঢোকানোর মত। টেরই পাবেন না। টের পেলাম। তবে এ নিয়ে চিৎকার চেঁচামিচি আমার স্বভাব নয়। তবে রক্তনালী দিয়ে কিছু একটা ঢুকানো হচ্ছে সেটা টের পাচ্ছি। আর কেন যেন পশাদ্দেশে প্রচন্ড গরম লাগছে, মনে হয় উত্তপ্ত রেডিয়েটরের উপর বসে আছি। কয়েক বার  ভেবেছি বলি, তবুও সহ্য করাটাই ঠিক মনে করলাম। কয়েক বার জানতে ইচ্ছে করেছে আর কতক্ষণ। কিন্তু সেটাও মুখ বুঝে সহ্য করে গেছি। আসলে আমাদের সব ভয় অজানা থেকে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। সেই জ্ঞান আমাদের মন থেকে ভয় দূর করে  বিপদ মোকাবিলায়  সাহস যোগায়। তাই এটাকে একটা লারনিং প্রসেস হিসেবে মেনে নিয়ে  সামনে তাকানোর চেষ্টা করলাম। "তোমার রক্তনালী পরিষ্কার। আমরা করনারিগ্রাফি আর এঞ্জিওগ্রাম করে কোন সমস্যা দেখলাম না। অন্তত ম্যাসিভ হার্ট আট্যাকের সম্ভাবনা নাই। এই মুহূর্তে অপারেশনের কোন প্রয়োজন নেই। ওষুধ খেয়েই সমস্যার সমাধান হবে।" একদিকে হাঁফ ছেঁড়ে বাচলাম, কিন্তু সেই সাথে এলো নতুন প্রশ্ন, কেন মাঝে মধ্যে এরকম সমস্যা হচ্ছে। নেগেটিভ উত্তর একটা সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলেও কারণটা এখনও জানা যায়নি। যাহোক ডাক্তারদের ধন্যবাদ দিলাম। ওরা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো আগের জায়গায়। বললাম, "কোন সমস্যা নেই। আমি কি এখন চলে যেতে পারি? তাহলে ট্যাক্সি ডেকে দাও।" "বলেন কী? হয়তো এত জরুরি ভাবে টেস্টটা না করালেও চলত। কিন্তু এসে যখন পরেছেন, কয়েকটা দিন তো থাকতেই হবে। এখন আপনাকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানেই থাকবেন। কাল ডাক্তার এসে ঠিক করবেন পরবর্তী কার্যক্রম।"

জীবনে এই প্রথম হাসপাতালে থাকা। আমি যখন ১৯৮৩ সালে মস্কো আসি, আমার ওজন ছিল মাত্র ৪৩ কেজি। সবাই শিওর ছিল একটা ছেলেও যদি হাসপাতালে যায় সেটা হব আমি। এরপর কেটে গেছে সাইত্রিশ বছর। রোগ বালাইয়ের প্রতি আমার দয়ার শেষ নেই। কী রোগ যে নেই আমার শরীরে? আমার যে রোগের ইতিহাস সেই বইটা রামায়ণ মহাভারতের থেকেও মোটা হয়ে গেছে। আমি বলি আমার চেয়েও স্বাস্থ্যবান। কিন্তু আগে কখনও হাসপাতালে রাত কাটাইনি। তবে সব কিছুই একসময় না একসময় শিখতে হায়। আর শিখতে যখন হবেই সেটা চোখ কান খোলা রেখে শেখাই ভালো। আমি যেখানে আছি সেটা দ্মিত্রভ রিজিওনাল হাসপাতালের কারডিওলজি বিভাগ। বিল্ডিঙটা নতুন। চার তলা। নীচের ফ্লোরগুলোর  কাজ এখনও চলছে। চার তলায় আমরা। প্রশস্ত ঘর। আমার ঘরে সব দেখে মনে হল ৫ বেডের। এটা কলিং বেল, সকেট এসবের হিসাবে। আমি ৬ নম্বর বেডে। জায়গার অভাব হয়নি, তবে মনে হল এসব জরুরি অবস্থার জন্য। লোকজন বেশ। সাথে কর্মীদের সংখ্যাও। ওয়ার্ডের ভেতরেই ওয়াশ রুম। প্রতি আধ ঘণ্টা পর পর ঘর পরিস্কার করছে। এই ইঞ্জেকশন দেয় তো এই স্যালাইন। সকালে বিকালে তাপমাত্রা দেখছে। সময় মত ট্যাবলেট এনে দিচ্ছে। সকাল সাড়ে ছয়টায় থার্মোমিটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যায়, সেই সাথে সকালের ওষুধ। ঝুলিয়ে দিয়ে যায় স্যালাইন। ৯ টায় আনে ব্রেকফাস্ট। সাধারণত পরিজ আর রুটি মাখন, চা বা জুইস। এরপর ট্যাবলেট। অন্য এক সিস্টার আসে স্যালাইন দিতে। ১ টার দিকে লাঞ্চ। স্যুপ, আলু বা গ্রেচকা মাংস দিয়ে। ৪ টার দিকে হালকা খাবার, এরা বলে পলদনিক। কম্পোত, বিস্কুট আর আপেল বা অন্য ফল। ছয়টার দিকে ডিনার। আলু বা গ্রেচকা, মাছ সেদ্ধ। এরপর খাবার নেই। অনেকের আত্মীয় স্বজন খাবার এনে দিয়ে যায়। কেউ কেউ ফলটা রাতের জন্য রেখে দায়। আমি রুটি আর জুইস রেখে দিলাম। এক কথায় এখানে আসার ব্যাপারে আমার প্রিপারেশন ভালো ছিল না। আগে জানলে কিছু ড্রাইফুড নিয়ে আসতাম। রুমমেটরা বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে যখন শুনে আমি দুবনা থেকে তখন কদর বেড়ে যায়। জিজ্ঞেস করে কাজে কথা, কতদূর পড়াশোনা। সেসব শোনার পর কদর আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন ব্যাপারে গল্প হয়। রাজনৈতিক ব্যাপারে কথা হয়। তাছাড়া আমার সেন্স অফ হিউমার ওদের আপন করতে সাহায্য করে। গতকাল সকালে ডাক্তার এলেন। আমাদের বয়েসী বা আরও কম। মারিনা পেত্রভনা। বললেন "আপনার এখানে দীর্ঘ সময় থাকার দরকার নেই। তবে আরটারিতে একটু ফুটো করতে হয়েছিল। তাই হাতের ব্যাণ্ডেজটা শুধু আমাদের ডাক্তাররাই খুলবে। বাসায় করা যাবে না, রিস্কি। এরপর বারো ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখবে। তাছাড়া আপনার শররী কিছু কনট্রাস্ট দ্রব্য ঢোকানো হয়েছিল। সেটা বের করতে স্যালাইন দিতে হবে। তাই আগামী কাল পর্যন্ত আপনাকে থাকতেই হবে। কিন্তু সমস্যা হল নববর্ষের কারণে কাল কোন ডাক্তার থাকবে না, থাকবে শুধু অরদিনাতররা। ওরা তো আপনাকে ছেঁড়ে দিতে পারবে না। আমরা কাজে ফিরব ৩ জানুয়ারি। এতদিন এখানেই থাকতে হবে।" "সেটা তো হচ্ছে না। আমার এখানে থাকার কি মানে তাহলে? আপনাদের মত আমারও তো নববর্ষ আছে।" তাহলে আজ আমার ব্যান্ডেজ খুলে দিলে আমি রাতেই চলে যাই।" "ইম্পসিবল!" "তাহলে?" "আপনি একটা রিফিউসাল লেটার লিখে যেতে পারেন। সেখানে বলবেন যে আপনাকে এখন না যাওয়ার জন্য সাবধান করা হয়েছিল। সব জেনেও আপনি নিজ দায়িত্বেই বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।" "ঠিক আছে। তাই করব।'" 

ফ্যামিলি গ্রুপে জানালাম। সেভা লিখল, "তুমি ভাজা পোড়া খাও, তাই এত সমস্যা।" ও আগে আমার রান্না পছন্দ করত। যত দিন আমাদের সাথে ছিল, আমাদের রান্নাই খেত। গত কয়েক বছর ওরা নিজেরাই মস্কো থাকে। মনিকা, ক্রিস্টিনা আর সেভা। মেয়েরা সাধারণত বাইরে বাইরে খায়। সেভা খেত ফাস্ট ফুড। কেএফসি ইত্যাদি। করোনা কালে তিন ভাইবোন মিলে রান্না করে খেলেও ইদানীং সেটা করে না। সেভার মাথায় ঢুকেছে হেলদি ফুডের ভূত। ওজন বাড়াতে চাইছে। আমি নিজেও ওজন নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম, তবে হেলদি ফুড খেয়ে সেটা করার মত মনের জোর ছিল না। অনেক বলার পরও হারকিউলিস মুখে তুলতে পারিনি। তবে সেভার মনোবল আছে।  ফলে এখন ও শুধু সেদ্ধ খায়। গত সপ্তাহে যখন এলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি রাঁধব, মাংস না মুরগী?" "তুমি যা রান্না কর আমি খাব না।" "কী খাস?" "সেদ্ধ মাংস।" আমি হাঁফ কেজি মাংস, গোটা দুই আলু, একটু লবন, তেজ পাতা, গোল মরিচ আর পেঁয়াজ সেদ্ধ বসিয়ে দিলাম। আমারও ঝালেমা কমল, সেভাও খুশি। ও আমাকে সেটাই জানিয়ে দিল। হাসপাতালে এসে দেখলাম সেভা সেসব পথ্যই খাচ্ছে।   
দেমিদের সাথে কথা বললাম। ও জানাল, ৩১ তারিখ ১২ টায় আসবে আমাকে নিতে। সকালে আবার স্যালাইন দিয়ে কাটেটর খুলে নিল। বুঝলাম, আর স্যালাইনের দরকার নেই।" এর মধ্যে রুমমেটদের সাথে ভাব হয়ে গেছে। একটু খারাপই লাগছিল ওদের ছেঁড়ে আসতে। আমি খুব একটা কোথাও যাই না। ১৯৯৪ পর থেকে কয়েক বার ফ্যামিলি নিয়ে কৃষ্ণ সাগরে যাওয়া ছাড়া আমার সব ট্রিপ কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু যেখানেই যাই, মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা আপন করে নিই। আসলে আমার ফিলসফি এমন, আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আমি, তাই আমি যখন যেখানে সেটাই সব চেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। "নদীর এপার কহে ছাড়িয়ে নিশ্বাস, ওপারেতে যত সুখ আমার বিশ্বাস।" এটা আমার মন্ত্র নয়। আর সব সময়ই চেষ্টা করি পরিস্থিতি থেক কিছু শিখতে। কেননা নিজের অভিজ্ঞতা যত দ্রুত মানুষকে শেখায় শত বই পড়েও সেটা পাওয়া যায় না। তবে সেজন্য দরকার শেখার আগ্রহ, খোলা মন। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম। তবে কাগজপত্র এখনও হাতে পাইনি। ওসব পাওয়া যাবে ৩ তারিখের পর। দেমিদকে বলে রেখেছি, সেদিন ক্যামেরা নিয়া যাব। আমরা ফিরেছি ভেতরের এক রাস্তা ধরে। রাস্তায় অনেকগুলো চার্চ পড়েছে সেগুলোর ছবি তোলা যাবে। আর ওদিন ডাক্তার ও নার্সদের জন্য কিছু চকলেট নিয়ে যাওয়া যাবে চকলেট বয়ের পক্ষ থেকে। 
বাসায় ফিরে দেখি গুলিয়ার মন খারাপ। দুদিন নাকি ঘুম হয়নি। দেখি বিভিন্ন সালাদ তৈরি করতে ব্যাস্ত। অযথা ঝামেলা। বাচ্চারা না থাকলে এসব ঝামেলার কোন অর্থ হয় না। মানুষ তো মাত্র দুজন। সুপার মার্কেট থেকে একটু একটু করে সব কিনে আনলেই হত। কেননা এ খাবার আমাদের শেষ হবে না। হয়তো মস্কো যেতে হবে ছেলেমেয়েদের খাবার দিতে। যদি ওদের পছন্দ না হয় আবার গুলিয়ার মন খারাপ হবে, এত কষ্ট করে করলাম, ওরা খেলো না। অথচ এখানে অন্য কারও কোন দোষ নেই। 

এর মধ্যে অলরেডি পুরান বর্ষকে বিদায় জানিয়েছি। শ্যাম্পেন খোলা হয়েছে। রম ওভাবেই আছে। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না, যদি আবার প্রেসার বাড়ে। তাছাড়া এখন আর এসব তেমন ভালো লাগে না, ছাত্র জীবনে আর বাচ্চাদের ছোটবেলায় খুব হৈচৈ করে নববর্ষ পালন করতাম। লুকিয়ে ক্রিস্টমাস ট্রির নীচে রাখতাম সবার জন্য উপহার। ওরা এখন এসবে বিশ্বাস হারিয়েছে।  বিশেষ করে কসমোলজির উপর কাজ করে বুঝেছি এসব কতটা শর্ত সাপেক্ষ।  মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্কহীন। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এসব থেকে বুঝি কোন এক সময় এরা ছিল সপ্তম, অষ্টম মাস। মানে মার্চ ছিল বছরের প্রথম মাস। আসলে বছরে চারটে এরকম দিন হচ্ছে  মার্চ,  জুন, সেপ্টেম্বর ও  ডিসেম্বরের ২১ থেকে ২৩ তারিখ যখন হয় দিন রাত সমান হয় অথবা সব চেয়ে বড় বা ছোট দিন হয়। তারপরেও বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতিতে এসব দিনের গুরুত্ব অপরিহার্য। এর মধ্যে ২০২০ র বারোটা বেজে গেছে। ২০২১ দরজায় নক করছে। আমরাও শ্যাম্পেনের গ্লাসে টোকা দিয়ে ওকে বরণ করেছি।  বছর এটা স্পেস টাইমের টাইম আক্সিসের স্বরূপ। সময় সময়ই। সে ভালও নয়, মন্দও নয়। শুধু আমরাই পারি নিজেদের জীবনকে সুন্দর করতে। আগামী বছরে সবাই সে চেষ্টাই করবেন বলে আশা রাখি। তবে নিজে ভালো থাকতে হলে আগে অন্যকে ভালো রাখতে হবে। নিজে স্বাধীন হতে হলে অন্যের অধিকারকে মর্যাদা দিতে হবে। এর কোন অল্টারনেটিভ নেই। 
সবাইকে শুভ নববর্ষ।         
 
দুবনা, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ - ০১ জানুয়ারি ২০২১  



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি