জন্মদিনের হিসাব নিকাশ

গতকাল ছিল আমার জন্মদিন। এক অদ্ভুত জন্মদিন।করোনা কাল বলেই কিনা কে জানে? যাহোক, বরাবরের মতই অনেক শুভেচ্ছা, ভালবাসা আর শুভ কামনার নীচে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। মৃত্যুর পর মানুষ মৃতের প্রতি অনেক ভালো ভালো কথা বলে। রুশ দেশে বলে, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে হয় ভালো বলবে, নয়তো কিছুই বলবে না। তবে সমস্যা হল, মৃত ব্যক্তি এসব ভালো কথা শুনতে পায় না। জন্মদিনেও আমরা কমবেশি ভালো কথা বলি। তাই জন্মদিনকে বলা যায় নিজের সবলতা সম্পর্কে একটা জনমত জানার দিন। তার সাথে বাকি ৩৬৪ দিনের মতামত মিলিয়ে নিজের একটা গড়পড়তা গণ চরিত্র আঁকা যায়। যারা জন্মদিনে আমার পাশে ছিলেন, মনে করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ফেসবুককে ধন্যবাদ আমার জন্মদিনের ক্যাম্পেইন করার জন্য। 


এবার আসি অদ্ভুত কেন সে কথায়। জন্মদিন এখন দিন দিন ফ্যাঁকাসে হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এই দিন নিজের জমি থেকে মটর শাঁক তুলে আনতাম। আসলে এ জন্যেই কিছুটা হলেও বাড়ির পাশের জমিতে মটর কলাই বোনা হত। এ দিনের মাস্ট আইটেম ছিল খিচুরি আর এই শাঁক। সাথে অন্যান্য সব - মিষ্টি, দই ইত্যাদি। আমি বাড়ির সবার ছোট, তাই সবার বন্ধুরাই আসত। ১৯৮৩ সালের পর মাত্র একবারই বাড়িতে জন্মদিন পালন করি, ১৯৯৭ সালে। তখন পুনায় একটা কনফারেন্সে যোগ দিয়ে দেশে ছিলাম। এরপর ২০১১, ২০১৪ আর ২০১৬ সালে দেশে থাকলেও ২৫ ডিসেম্বর সময় কাটিয়েছি সোভিয়েত ফেরত বন্ধুদের সাথে পিকনিকে। আর ২৬ ডিসেম্বর বাড়ির সবার সাথে। ২৭ বা ২৮ তারিখে মস্কো ফিরেছি নব বর্ষ ফ্যামিলির সাথে পালন করব বলে। বিগত দিনগুলোতে এ দিনটা কাটানোর চেষ্টা করি বাসায়। সবাই যখন একসাথে ছিলাম, এ দিন শুরু হত ক্রিস্টমাস ট্রি সাজানোর মধ্য দিয়ে। যেহেতু বছরের শেষ, কাজের চাপ তাই বেশি। ফলে এদিনটা কোন মতে পালন করে অপেক্ষা করতাম নব বর্ষ আর সেভার জন্মদিনের জন্য। ওটাই ছিল মূল অনুষ্ঠান। এখন মস্কোয় ওরা নিজেরা কেক কাটে, এখানে আমি। আর দেশের বাড়িতে বরাবরের মতই খিচুরির ব্যবস্থা। 
এবার অবশ্য সবই অন্যরকম। সেভা এল ২৪ তারিখ গভীর রাতে। আর এরপর এল মাথা ব্যথা আর প্রেসার। আমি উচ্চচাপের রোগী। আবহাওয়ার একটু ওঠানামা হলেই শরীরের
আবহাওয়ায় ঝড় ওঠে। রাত তিনটায় ঘুম ভাঙল কুকুরের ডাকে। সেভার ওখানে মিউজিক বাজছে। ফোন করলাম। উত্তর নেই। উঠে মিউজিক বন্ধ করে দেখি কীরকম একটা অস্বস্তি অনুভব করছি। বাইরে বরফ পড়ছে। প্রেসার মেপে দেখি হাই। ট্যাবলেট খেলাম। কোন কাজ হল না। কিছুক্ষণ বাদে আরেকটা। মনে হতে শুরু করল বিভিন্ন কথা। কত মৃত ব্যক্তির কথা যে মনে হল! ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় যখন ফটো ক্লাবে গেলাম ভাসিলি জিজ্ঞেস করল "কী খবর?" স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম "দৃঢ় পদক্ষেপে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।" ও আমার এসব হেঁয়ালি কথা শুনে অভ্যস্ত। নতুন আসা ইলিয়া বলল, "কষ্ট করে হাঁটার দরকার নেই। ঘরে বসে থাক। মৃত্যু নিজেই আসবে।" ভাবলাম, কোন ঝামেলা হলে এরা বলবে "বিজন আগে থেকেই জানত। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা ছিল।" যাহোক, রাতে ঘুম তেমন হল না, ২৫ তারিখ সকালে উঠতে হল। কিছু ইঞ্জেকশন নিতে হবে। বছরে একবার করে শরীরটাকে ডাক্তার নামক এক মেকানিক্সের কাছে রেখে আসি অয়েলিং করার জন্য। এখন সেটাই চলছে। ডাক্তারকে রাতের ঝামেলার কথা বললাম। উনি দুই ধরণের দুটো ট্যাবলেট খেয়েছি জেনে একটু বকলেন আর এমতাবস্থায় কী করতে হবে বলে দিলেন। বাসায় ফিরে সেভাকে নিয়ে ঘুরতে গেলাম ভোলগার তীরে। ওই যেতে চাইল। আগে যখন ব্ল্যাক হোল নিয়ে উৎসাহ দেখাত প্রায়ই ফোন করত। এখন শেয়ার মার্কেট নিয়ে বলে। তাই আমি ভাসিলির সাথে একটু কথা বলেছিলাম এ ব্যাপারে। ওখানেও কিছু কিছু অংকের কাজ আছে। ইন্টারেস্টিং। আমি ও ব্যাপারেই ওকে বলতে চাইলাম। কিন্তু সেভা ওয়ারেন বাফেটকে বেশি গুরুত্ব দেয় আর কাজের আনন্দের চেয়ে লাভ-লোকসানের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। তাই কথা তেমন জমল না। নিট লাভ অনেক দিন পরে দুটো ছবি তুলতে দিল আর আমি যখন প্রকৃতির ছবি তুললাম বিরক্তি প্রকাশ করল না। বাসায় ফিরে আবার শুরু হল মাথা ব্যথা। সুতরাং সময় কাটল শুয়ে বসে। এই প্রথম গুলিয়াকেও দেখলাম একটু চিন্তিত হতে। ও সাধারণত ওষুধ খাওয়া বা ডাক্তার দেখানো পছন্দ করে না। রাতের দিকে যখন প্রেসার নামছে না আর মাথা ব্যথা যাচ্ছে না, ইমারজেন্সি কল দিলাম। বললাম কী ওষুধ খেয়েছি, জানতে চাইলাম কী খেতে হবে। ওরা প্রেসারের ওষুধ খেতে বলল আর তাতে মাথা ব্যথা না সারলে সেজন্য ওষুধ খেতে বলল, কেননা প্রেসারের কারণেই মাথা ব্যথা। আমি বললাম, আমার মনে হয় উল্টো। তাই আমি আগে মাথা ব্যথার ওষুধ খাবো, তারপরে খারাপ লাগলে প্রেসারের। কিছুক্ষণ যুক্তিতর্কের পরে ভদ্রমহিলা বললেন, ঠিক আছে সেটাই কর। মাথা ব্যথা কমল, প্রেসার হাই থাকলেও এখন অনেকটা নেমেছে। তাই রাতে আরেকটা মাথা ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আর খারাপ লাগছিল না, যদিও অনেকটা হ্যাং ওভার ভাব ছিল। সকালে আবা ইঞ্জেকশন নিতে গেলাম, পরে সেভাকে নিয়ে বনে। সব মিলিয়ে হাঁটলাম প্রায় ৯ কিলোমিটার। এখন আর ততটা খারাপ লাগছে না, যদিও দুর্বলতা আছে। ইচ্ছে ছিল জন্মদিনে পিঁয়াজি আর মুঘলাই করার চেষ্টা করব। হতে পারে ওরাই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বাঁচতে আমাকে কাবু করেছে। কিন্তু এক ফাল্গুনে তো বসন্ত যায় না। ও হ্যাঁ, আমি বরাবরই জন্মদিনে কিছু লোকের শুভেচ্ছা আশা করি। এরা আমার ছাত্রজীবনের রুমমেট ইয়েভগেনি আর দুবনায় পরিচয় হওয়া আল্মা আতার এক বন্ধু ফিওদর। ওদের বার্তা পেয়েছি। এই প্রথম দিদির ফোন আসেনি। গত বছর ২৫ ডিসেম্বর আমাকে শেষ বারের মত নিজে ফোন করেছিল। এরপর অসুস্থ হয়ে পরে। অন্য জগতে এখনও সুকেরবাকেরা জন্ম নেয়নি। 


দুবনা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি