রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ

গত শনিবার ১০ই মে মস্কোস্থ বাংলাদেশ দুতাবাসে পালন হলো রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী|  আমার তিরিশ বছরের মস্কো জীবনে এই প্রথম| এটা দুতাবাসের নিজের উদ্যোগেই হোক, আর সরকারী উদ্যোগেই হোক – নিঃসন্দেহে একটা সুন্দর প্রয়াস| জানি এ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলবেন, দেশের বর্তমান বাস্তবতার কারণে সরকারের এসব প্রয়াসকে অনেকে হেয় করে দেখবেন, তবে আমার মনে হয় যেকোন ভাল উদ্যোগের  প্রতি সাধুবাদ জানানো দরকার| আসলে জীবন মানেই তো একপা এগুনো আর দুই পা পেছানো, বা দুই পা এগুনো একপা পেছানো| স্থিতিশীলতার জন্যই এটা দরকার| বিশ্ব চলে এই নিয়মে, সরল গতি আমাদের সামনে নেয় ঠিক ই, তবে ঘুর্ণন আমাদের পেছাতে বাধ্য করে| আর এটা আছে বলেই আমরা আছি| আজকাল আমাদের মধ্যে অন্যের ভাল কাজের স্বীকৃতি দেবার সাহস বড়ই কম| মনে হয় ভাল মন্দ ব্যাপার না, কে করছে এটাই আসল কথা| সারা পৃথিবী জুড়েই এই অবস্থা| যাকগে – এবার আসি রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তীর কথায়| আমাদের ছোট বেলায় আমরা রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জন্মজয়ন্তী পালন করতাম| সুকান্ত ছিলেন বিপ্লবের কবি| সমাজতন্ত্রের সাথে সাথে সুকান্তও বিদায় নিয়েছে| এদিক থেকে ভাগ্যবান চে – এখনো সাম্যের প্রতীক হয়ে বেচেঁ আছে অন্তরে অন্তরে|  
আমি এখানে শুধু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই| জানি কথাগুলো সবাই জানেন, তবুও মনে মনে যে কথাগুলো বলি, তাই লিখা আর কি? যদি কেউ পড়ে বা ভাবে এভাবে – এ আশায়| রবীন্দ্রনাথ মারা যান ১৯৪১শে – দেশ ভাগের আগে| যদিও ওনার জীবদ্দশায়ই পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে উঠে, তবে বিভিন্ন লেখালেখি থেকে এটাই বেরিয়ে আসে যে দেশভাগটা অনিবার্য হয়ে পড়ে ১৯৪৬এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর| মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এর “India wins freedom”, নেহরুর বিভিন্ন লেখা বা শেখ মুজিবের “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” থেকে যেটা বোঝা যায়, অনেকদিন পর্যন্ত মুসলিম লীগ ছিলো উচ্চ শ্রেনীর মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ| এটাও ধারণা করা হয় যে, এটা ছিলো ইংরেজদের তৈরী, মূলতঃ কংগ্রেসকে মোকাবিলা করার জন্য| আমি সে বিতর্কে যাচ্ছি না, তবে এটা ঠিক পাকিস্তানের দাবী না পশ্চিমে, না বাংলায় – কোথাও জনপ্রিয় ছিলো না| যার ফলে বাংলায় জিতে ফজলুল হকের দল, আর সীমান্তে সীমান্ত গান্ধী| কিন্তু পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দি আর শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান আন্দোলনকে বাংলায় জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন| মুসলিম লীগ হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের পার্টি, আর পাকিস্তানের দাবী হয়ে ওঠে মুসলিম মধ্যবিত্ত ও মুসলিম সাধারণ মানুষের| আর এটাই পথ করে দেয় পাকিস্তানের জন্মের| এদিন থেকে দেখতে গেলে পাকিস্তানের ভ্রুণ বাংলার বাইরে সৃষ্টি হলেও এর আতুরঘর ছিলো বাংলায় – বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মাটিতে| আর পাকিস্থানকে পাবার জন্য বাংলার মুসলিম যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী তাদের প্রতিবেশী হিন্দুদের ত্যাগ করতে মোটেই কুন্ঠিত ছিলনা| চিরপরিচিত মানুষের মুখের থেকে পরিচিতি মাটির মূল্যটা অনেক বেশী বলে মনে হয়েছিলো| আর এর ফল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা – দুই সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের ছিন্নমূল হওয়া| তবে বাংলার মুসলিম তার হিন্দু প্রতিবেশীকে ত্যাগ করতে রাজী হলেও বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে ত্যাগ করতে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা| আর ওই সময় বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশে ছিল হিন্দু নামের মেলা| রাজা রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত (উনি খ্রীস্টান ধর্ম অবলম্বন করেন), বম্কিম চন্দ্র, শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ আরো কত নাম| নজরুল ইতিমধ্যে উদিত হলেও মুসলিম কবি  লেখকদের সংখ্যা তখনো এত বেশী নয়| শামসুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস – এরা সবাই ভবিষ্যতের গর্ভে| তবে চল্লিশের দশকে বাংলার মুসলিমদের মধ্যেও দেখা দেয় নতুন জাগরণ, আর এরাই প্রথমে বুঝতে পারেন বাংলার অস্তিত্বের জন্য নজরুলের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনটা কতখানি| আর এটা বুঝতে শাষক শ্রেণীরও দেরি হয়নি| তাই তো তারা রবীন্দ্র সাহিত্য, রবীন্দ্র সঙ্গীত বর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন| আর বাংলার বুদ্ধিজীবী এর উত্তরে আরো জোরে আকড়ে ধরেন রবীন্দ্রনাথকে| রবীন্দ্রনাথ হয়ে  ওঠেন বাংলার অন্যতম প্রতীক| তার সোনার বাংলা হয়ে ওঠে স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার| আর স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত| আজ দেশে যে রবীন্দ্র চর্চা – সেটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়| এটা জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর অস্তিত্বের এক অনিবার্য উপাদান| সেদিক থেকে দেখতে গেলে সরকারী পর্যায়ে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন করার এই উদ্যোগ – এটা খুব ই গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত|


১৪ মে, ২০১৪|  



      
               

Comments

Popular posts from this blog

রিপন

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি