২০১৭


গতকাল আমরা ২০১৬ কে বিদায় দিয়ে বরন করে নিলাম ২০১৭ কে। কি সোভিয়েত ইউনিয়নে, কি নতুন রাশিয়ায় – নববর্ষ সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক প্রাযদনিক বা অনুষ্ঠান। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই শুরু হয় কেনাকাটা। মেয়েরা তখন থেকেই বইএ বা ইন্টারনেটে খুজতে থাকে নতুন ডিশের রেসিপি। ওই সময়কার সমস্ত কথাবার্তাই চলে নভি গদ বা নতুন বর্ষকে ঘিরে। রাস্তায় রাস্তায়, দোকানে দোকানে এমনকি মানুষের মনে মনে উৎসবের আমেজ।
সাধারণত ডিসেম্বরের ২৪ বা ২৫ তারিখেই আমরা ইওল্কা বা ক্রিস্টমাস ট্রি সাজাই। ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন বিধায় চেষ্টা করি ওই দিনই ইওল্কা সাজাতে। তবে এটা মুলত হত ২০০৯ এর আগে, যখন সবাই মিলে দুবনায় থাকতাম। এর পর থেকে ইওল্কা সাজানো হয় যখন আমি মস্কো আসি। ইওল্কা কেনার দায়িত্ব বরাবরই আমার উপরেই পড়ে, তবে গত কয়েক বছর আমরা আর্টিফিশিয়াল ইওল্কা ব্যাবহার করি, যতটা না প্রকৃতির জন্য ভালবাসা থেকে, তার চেয়ে বেশী অর্থনৈতিক সুলভতার কারনে। তাছাড়া দুবনায় জীবন্ত ইওল্কার কাটা থেকে যত সহজে মুক্তি পাওয়া যেত, মস্কোয় ব্যাপারটা তত সহজ নয়।
এবার পুরো ডিসেম্বরটাই দেশে থাকার ফলে সব কিছু একটু অন্যভাবে হয়েছে। আমি ৩০ ডিসেম্বর রাতে যখন মস্কো পৌঁছি, ইওল্কা তখনও আলমারির উপরে বাক্স বন্দী। মনিকা ৩১ শে সকালে কাজে যাবার আগেই বলে গেল আমি যেন ইওল্কা বসিয়ে রাখি, ও এসে সাজাবে। তবে বরাবর যেটা হয়, আমি আর গুলিয়াই ইওল্কা বসাই, সাজাই, রান্নাবান্না সব করি। তাই ওরা যে করবে সে ভরসায় বসে থাকতে পারি না। এরই মধ্যে  ক্রিস্টিনাও বেরিয়ে গেল নিজের কাজে। আন্তন আসবে রাত ১১ টার দিকে, কাজ শেষে। তাই যত ভরসা নিজেদের উপর আর সেভার সুবুদ্ধির উপর। তাই আমরা শুরু করলাম রান্না দিয়ে। এ সব অনুষ্ঠানে আমি সাধারণত পোলাও (প্লভ) করি আর যদি মাছ বা মাংসের আইটেম থাকে সেটা করি। গুলিয়ার দায়িত্ব সালাদসহ বিভিন্ন স্টারটার করা, সেগুল সাজানো আর টেবিল সাজানো। ইদানিং অবশ্য মনিকা টেবিল সাজায়, করে বেশ দ্রুত আর সো ভকুসম মানে রুচিপূর্ণ ভাবে।
আমরা যখন দু জনে কাটাকাটি আর রান্নায় ব্যাস্ত, সেভা ব্যস্ত তার ট্যাঙ্ক অন লাইন খেলায়। অনেক বার বলেও ওকে ওঠানো যাচ্ছিল না। তবে অনেক চেষ্টার পরে ও শেষ পর্যন্ত ঘর পরিষ্কার করতে রাজী হয়। পাঁচ  মিনিট পরে দেখি আবার গেইম নিয়ে বসেছে। মেজাজ গেল চড়ে, বললাম এক্ষুনি যেন বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়। কোন কিছু না বলে জামাকাপড় পড়তে শুরু করল ও, শুধু যাবার আগে বলল ঘরটা ও ঠিকই পরিষ্কার করেছে। নিজেরই খারাপ লাগলো। আমিও নিজেও সব কাজ খুব দ্রুত করি, তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। আর গুলিয়া ভাবে আমি কাজটা না করেই নেটে বসে আছি। আজ সেভার সাথে একই রকম ব্যাবহার করে নিজেকে কেমন জানি অপরাধী বলে মনে হোল।
এক সময় বউ হাতে এক টুকরা ভেরার মাংস ধরিয়ে দিয়ে বলল প্লভ রান্না করতে। মাত্র কদিন আগে বাড়ীতে ৩০০ লোকের পোলাও রান্না করতে দেখলাম। আগ্রহ নিয়ে শুনলাম কিভাবে রান্না করে। আর ২৬ তারিখে আমার জন্মদিন উপলক্ষে (২৫ তারিখে আমি সাব এর পিকনিকে থাকায় নিজের জন্মদিন একদিন পিছিয়ে যায়) ভ্রমর বিরানী করলে ওর কাছ থেকে সে রেসিপিও জেনে নেই। তাই ঠিক করলাম এই দুই রেসিপির সমন্বয়ে নিজস্ব কিছু একটা করতে। যদি ভাল হয়, তাহলে মিশন সাকসেসফুল। মন্দ হলে হাঁড়িপাতিলের ঘাড়ে দোষ চাপালেই ল্যাঠা চুকে যাবে। তবে ৩১ শে রাতে বিভিন্ন সালাদ, পানীয়, চকলেট আর ফলের পরে বিরানী তো দুরের কথা আরো দুটো সালাদ পর্যন্ত টেস্ট করা হয়নি। আর ১ তারিখে সকালে  বিরানী কেন ডালভাতও খুব সুস্বাদু মনে হয়।
দেখতে দেখতে রাত ৯ টা বেজে গেল, রান্না তখনও শেষ হয়নি। মনিকা ফিরে এসে ইওল্কা বসানোর জন্য জেদ ধরল। কি আর করা, মিনিট পনের পরে আমি ইওল্কা বসিয়ে ওদের হাতে খেলনা ধরিয়ে দিলাম। মনিকা-ক্রিস্টিনা দু বোনে মিলে খুব ভালই সাজালো ইওল্কা। এতে আরেকটা সমস্যার সমাধান হোল। যদি ওরা ইওল্কা না সাজিয়ে টিভি দেখত তাহলে মায়ের গালি একটাও মাটিতে পড়তো না। আর ইওল্কার কল্যানে সবাই ব্যাস্ত রইল, কাজও হোল। পরবর্তীতে এই কৌশলটা কাজে লাগাতে হবে।
রাত সাড়ে ১০ টায় রান্না শেষ হোল। আমি টেবিল পাতলাম। মনিকা আর ক্রিস্টিনা গুলিয়ার সাথে সাজিয়ে ফেললো টেবিল। এর পর এল আন্তন। সাড়ে এগারোটায় বসলাম পুরান বছরকে বিদায় জানাতে। এতদিন পর্যন্ত শ্যাম্পেনের বোতল আমিই খুলতাম, এবার আন্তন নিজেই ওটা করলো। আর করল আমার থেকে অনেক বেশী প্রফেশনালি। কয়েক বছর বারে কাজ করার অভিজ্ঞতা একেবারে বৃথা যায়নি।      
গত ৯ই ডিসেম্বর ক্রিস্তিনার ১৮ বছর পূর্ণ হোল, তাই এখন পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে শ্যাম্পেন দিয়ে টোস্ট করতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রথমে ২০১৬ কে বিদায় জানালাম এক বোতল শ্যাম্পেন দিয়ে। এর পর পুতিনের নিউ ইয়ার্স উইশ শোনা ও ক্রেমলিনের কুরান্ত বা ঘণ্টা বাজার মধ্য দিয়ে ২০১৭ কে গ্রহন করা। আবারো প্রথাগত ভাবে মনিকা, ক্রিস্টিনা আর সেভা ছোট কাগজে ওদের উইশগুলো লিখে পুড়িয়ে তা ফেললো নিজেদের পানীয়ের গ্লাসে। ওটা শেষ পর্যন্ত পান করলে নাকি সব ইচ্ছা পূরণ হয়।
দুবনার পর এই প্রথম এতটা উউতনি বা আন্তরিক পরিবেশে নববর্ষ বরন করলাম। দুবনায় থাকাকালীন পরিবারের সবাই (সংখ্যা নির্ভর করত বাচ্ছাদের সংখ্যার উপরে, সেভা অল্পের জন্য ২০০৩ এর নববর্ষ মিস করে, ওর জন্ম ২রা জানুয়ারী ২০০৩)। ২০০৯ সালে ওরা মস্কো চলে এলে এভাবে আর বসা হয়নি। সবাই যার যার মত ব্যস্ত, কখনো কখনো সবাই এক সাথে হলেও সবাই বিশেষ করে আন্তন আর মনিকা ব্যাস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের আড্ডায় চলে যেতে। অনেক দিন পরে এই প্রথম কারো কোন তাড়া ছিল না। রাত প্রায় ৩ টার দিকে যখন সবাই ক্লান্ত, আন্তন চলে গেল ওর আস্তানায় আর মনিকা রেড স্কয়ারে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে। পেছনে পড়ে রইল খাবারের পাহাড়। তবে গত ১৪ বছর এমনটাই হচ্ছে। ২ তারিখে সেভার জন্মদিন, তাই আমাদের প্রাযদনিক ৩১ শে ডিসেম্বর শুরু হয়ে শেষ হয় ৩ রা জানুয়ারী। কাক গভারিতসা গুলিয়াত তো গুলিয়াত।


ও হ্যা। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, নববর্ষের রাতে দেদ মারয বা সান্তা ক্লাউস এসে ওদের জন্য পাদারক বা গিফট রেখে যেত ইওল্কার নীচে। তবে বেশ কয়েক বছর দেদ মারয আর আসেনা, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছেলেমেয়েদের জীবন থেকে আরেকটা সুন্দর উপকথা ঝরে গেছে। গত কয়েক বছর বিভিন্ন কারনে আমারও ওদের জন্য কিছু কেনা হয় না। গত তিন বছর এ কাজটা  করে মনিকা। নিজের বেতন থেকে টাকা বাচিয়ে আমাদের সবার জন্য নিউ ইয়ার্স গিফট কেনে। ক্রেমলিনের   কুরান্তে বারোটা বাজলে ও বলে, “এখন সময় উপহারের।” তারপর এক এক করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয় একেকটা প্যাকেট। আমার আর আন্তনের ভাগে পড়ে শেভিং ক্রিম, লোশন এ সব। গুলিয়া পায় সেন্ট বা রান্নার সম্পর্কিত কিছু একটা। ক্রিস্টিনা আর সেভা জামাকাপড়। সেভা ডাবল সেট – দ্বিতীয়টা জন্মদিনের।       


মস্কো, ০১ জানুয়ারী ২০১৭     

             
              

         

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা