ভালোবাসার পথের ধারে
পড়ন্ত বিকেল। বনের ঐ বার্চগুলোর
মাথায় খেলছে রোদ। রাস্তার দুইধারে সাদাকালো বার্চগুলো দেখে মনে হয় যেন সারি ধরে দাড়িয়ে
আছে হলুদবরন কন্যা। বনের ভেতরে পড়ে থাকা আকাবাঁকা পথে এই হলুদবরন কন্যারা বিছিয়ে দিয়েছে
ঝরা পাতার নরম কার্পেট। আর ঐ পথ ধরে ধীর পদক্ষেপে হাঁটছে শরত। সে যাচ্ছে শীত কুমারীকে
বরন করতে। তাই এত হাসির মাঝেও তার চোখের কোনে লেগে আছে এক চিলতে বেদনার চিহ্ন। আমি
যাচ্ছি শরতের পিছু পিছু শরতের পথ ধরে। আনমনে।
“কি দোস্ত, মন খারাপ হয়ে গেলো?”
“নারে, মন খারাপ হবে কেন?”
“না, এমনি এমনি। সেই ১৯৮৩
সালে আমরা যখন এখানে হাঁটতাম আর দেশের গল্প করতাম, আমার ঝাঁকড়া চুল ছিল সবার ঈর্ষার
বিষয়। তোর অবশ্য চুল পড়ে নি, তবে পেকে গেছে।“
“নারে, পাকে নি। রঙ করেছি।
দেখনা, এখন বার্চগুলোর সাথে আমার কত মিল। আমিও ওদের মতই কাচাপাকা বাবু।“
“তা যা বলেছিস।“
“আচ্ছা, ইভান কেমন আছে রে?
ঐ দিনগুলোতে তুই প্রায়ই ইভানের কথা বলতি।“
হ্যা, মিকলুখো মাকলায়ার হোস্টেলের
পেছনে দাড়িয়ে আমি কথা বলছিলাম আহসানের সাথে। আমরা দুজনেই আসি ১৯৮৩ সালে। আমি ৬ সেপ্টেম্বর,
ও আমার এক সপ্তাহ আগে। দেশে আমার আলাপ ছিল না ওর সাথে। আমি আসি পার্টি স্কলারশীপে,
সাথে আরও ৫ জন প্যাত্রিসে, সব মিলিয়ে ১০ জন মাদি আর অন্য শহরে। তবে কিভাবে যেন আলাপের
প্রথম দিন থেকেই আহসান খুব আপন হয়ে গেছে। মস্কো জীবনে তো বটেই, আমার ৫২ বছরের জীবনে
আহসান অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধুদের একজন। মনে আছে, তখন মস্কোয় অমলদা আর হামিদ ভাইএর বন্ধুত্ব
ছিল সবার আলচনার বিষয়। আমাদের দুজনকেও অনেকেই মালাদই মানে ইওং অমল-হামিদ বলতো।
আহসানের উত্তরের অপেক্ষায়
মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখি, ও উধাও। হ্যা, ১৯৮৩ সেই কবেই হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে,
তবে তা এখনও প্রায়ই মনের জানালা ধরে উকি দিয়ে যায়। পরিচিত আর প্রিয় জায়গাগুলো দিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে এখন শুনতে পাই পরিচিত গলা, দেখতে পাই পরিচিত মুখ, মনের সিনেমার
পর্দায় একের পর এক ভেসে ওঠে ওরা, আর অনেক সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যায়
স্মৃতির আঁধারে।
রাস্তাটা ঠিক আগের মতই
রয়ে গেছে, শুধু মাঝে মধ্যে দু একটা নতুন লাভকা বা বেঞ্চ বলে দিচ্ছে নতুন যুগের কথা।
মাঝে মধ্যে দু একজন বৃদ্ধা ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। সেই আশির দশকের ভলিবল খেলা
আর নেই, নেই আমাদের ব্যাডমিণ্টনের কোর্ট, যেখানে বিকেলে আমরা বাংলাদেশী ছাত্ররা
মিলতাম একসাথে।
এসব ভেবে যখন যাচ্ছি, হঠাৎ
দেখি এক পরিচিত পাখি উড়ে এসে বসলো উচু এক ডালে। একটু ভালো করে তাকিয়ে চিনতে পারলাম
ওকে। পুরানো পরিচিত। আশির দশকেও প্রায়ই বসতো ওখানটায়, আর ওর ছবি তুলবো বলে অনেক
ঘুরে গ্রানিট এম ১১ নামে ৭০-২০০ মিমি একটা লেন্স পর্যন্ত কিনেছিলাম। এর পরে ওর
সাথে আর দেখা হয়নি, তাই ছবিগুলো দিতে পারিনি কোনদিন। ভাবলাম ওর ই-মেইলটা জেনে নেই।
কেবলই স্মার্টফোনটা বের করেছি লিখব বলে, পাখিটা উড়াল দিয়ে চলে গেলো অজানার
উদ্দেশ্যে। হ্যা, আজকাল পাখিরাও কাউকে বিশ্বাস করে না, অপরিচিত বা অল্প পরিচিত
কাউকে নিজেদের ফোন নম্বর দেয় না। হঠাৎই মনে পড়ে গেলো এক রবিবারের কথা। আমি ঐ সময় প্রায়ই
দৌড়ুতাম ঐ বনপথে। এক রবিবার গেছি দৌড়ুতে। শুরু করতাম দুই নম্বর ব্লক থেকে, লেনিনস্কি
প্রসপেক্ট বরাবর দৌড়ে যেতাম লেক পর্যন্ত, তারপর ডান দিকে মোড় নিয়ে ঢুকতাম বনের
গভীরে। সে দিনও তাই করেছি। কি কারনে জানি না, হঠাৎ কর আমার মাথার উপর দিয়ে কা কা
করতে করতে উড়ে গেলো এক ঝাক কাক। ভয়ে আমার হৃদপিণ্ড কখন যে গোড়ালিতে ঢুকে পড়েছে
খেয়ালই করি নি। আমি যেন নিজেই হিচককের “দ্য বার্ডস” সিনেমার অভিনেতা বনে গেছি। আমি চোখ বন্ধ করে লেজ গুটিয়ে কি দৌড়টাই না
দিলাম। যতক্ষন না আমি ওদের এলাকা থেকে বেড়িয়ে এলাম, ওরা আমার পিছু ছাড়ে নি। পরে
আমার রুমমেট বলেছিল, এটা ওদের বাচ্ছা তোলার সময়, তাই এলাকায় কোন বহিরাগত দেখলে ওরা
এমনটাই আগ্রাসী হয়ে ওঠে। জানি না আমি বিদেশী বলেই কাকেরা ঝাক বেধে আমাকে তাড়া
করেছিল, নাকি মানুষ বলে। এরপর আমি আর একা
কখনো ওদিকে দৌড়ুতে যাইনি। তাই জিজ্ঞেসও করা হয়নি কখনই। তাছাড়া আমি তখন পশু-পাখিদের
ভাষাটাও খুব ভালো জানতাম না।
কখন যে হাঁটতে হাঁটতে নয়
নম্বর ব্লকের ওখানে চলে এসেছি, বুঝতেই পারি নি। আমাদের সময় ওখানে মেয়েরা থাকতো, এখন
কে যে থাকে ঠিক বলতে পারব না। নতুন নতুন দালান-কোঠায় ভরে গেছে এ জায়গাটা। শুধু
দালান-কোঠা কেন, ক্যাফে-রেস্তরা আরও কত কি? তাই এখন এই বনে বই হাতে কাউকে দেখতে
পাওয়া যায় না। মনে আছে, ঐ সময় আবহাওয়া ভালো থাকলে অনেকেই বই নিয়ে চলে যেত বনে,
কখনো বা পড়াশুনা করতো, কখনো-বা সহপাঠীদের সাথে বসে আড্ডা দিত। এখন ঐ আড্ডা চলে
গেছে ক্যাফে-রেস্তরার চার দেয়ালের ভেতর। তবে আমি ঐ এলাকায় গেলো এখনও খুজি সেই
হারিয়ে যাওয়া সময়, হারিয়ে যাওয়া দেশ – যে দেশের নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভালোলাগার দেশ
– কষ্ট দেবার দেশ। সব কিছুর পর এ সেই দেশ যা আমাকে, আমাদেরকে, আমাদের দেশকে এমন কি
এই বিশ্বকে নিজের অস্তিত্বের বিনিময়ে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে, ঠিক যেমনটি একদিন
করেছিল সোভিয়েত দেশের মানুষ, কোটি কোটি জীবনের বিনিময়ে রুখে দিয়েছিল ফ্যাসিবাদের
অগ্রযাত্রা, ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ইউরোপকে, পৃথিবীকে, সমগ্র
মানবজাতিকে।
আমি হাঁটছি হাঁটছি, আর
অন্তহীন এই চলার পথে খুঁজে বেড়াচ্ছি ফেলে আসা দিনগুলো। কখন যে এসে পৌঁছিয়েছি মস্কো
নদীর ধারে। শরতের লাল-হলুদ ম্যাপেলের পাতার ভেতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে নভদেভিচি
মনাস্তিরের সোনালী চুড়া। লেকের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের দল। এই ছুটির দিনে আলো
ঝলমল এই শরত দিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে নববিবাহিত দম্পতিরা। চারিদিকে ক্যামেরায় ছবি তোলার
শব্দ। মনের পর্দায় আবার ভেসে উঠলো সেই দিনগুলো যখন সময় পেলেই চলে আসতাম দীপুর ঘরে,
প্রথম মেডিক্যালের হোস্টেলে। তারপর ক্যামেরা হাতে দুজন বেরিয়ে পড়তাম লেকের পাড়ে
হাঁটতে। কখনো বা সাথে থাকতো তপু, ইভান, অপু, রুমা ...............। একের পর এক
মুখগুলো ভেসে উঠছে মনের পর্দায় আবার পর মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টির আড়ালে। আর
ঐ সময়ের সাক্ষী হয়ে সামনে দাড়িয়ে আছে নভদেভিচি মনাস্তিরের উচু দেয়াল আর তার সোনালী
গম্বুজ। শরতের সোনালী রোদে এই গম্বুজ যেন সোনায় ভরে গেছে।
এরপর চলে আসি
সেরপুখভস্কায়া ভালে। ১৯৮৪ সালে, যখন পাভ্লভস্কায়া থাকতাম এপথ ধরেই যেতে হতো ক্লাসে।
পরে মিকলুখো মাকলায়ায় চলে গেলেও এখানে প্রায়ই আসতাম ছবি প্রিন্ট করতে। আর আরও পরে
হাঁটতে। সাথে থাকতো ভালোলাগার মানুষটা। হাঁটতাম আর শুনতাম, কখনো না বলা কথা, কখনো
বা নিস্তব্ধতা ভাঙ্গার জন্য কোন কথা। মনে পড়ে, অনেক পরে, ২০০৯ সালে সেভা যখন মস্কো
চলে আসে, আমি ফোন করলে ও ফোন ধরে বসে থাকতো, মেতে উঠত খেলায়। আর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ফোন ধরে বসে থাকতাম। সেভা চাইতো। কথা বলা নয়, আমি যে পাশে আছি, সেটা জানাই ছিল ওর
জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। ঐ আশির দশকে আমরাও ঠিক সেভাবেই হাঁটতাম, কথা নয়, পারস্পারিক
সান্নিধ্যই আমাদের মন ভরিয়ে রাখতো, স্বপ্ন দেখাতো। আজ তিরিশ বছরেরও বেশি পরে এ পথে
হাঁটতে হাঁটতে আমি আবার যেন সেই উপস্থিতি অনুভব করলাম, স্বপ্নগুলো যেন বাস্তবের
রূপ পেল। পেছনে তাকিয়ে দেখি দূরে বেঞ্চের উপর বসে আছে আমার সেই ভাললাগার মানুষটা,
পরনে তার সেই আকাশী সালোয়ার-কামিজ। সেদিনের মতো আজও যখন ক্যামেরা তাক করেছি, কোথায়
যেন উধাও হয়ে গেলো সে। আর বুলভারের হলুদ পাতায় ঢাকা গাছগুলো ভরে গেলো অপূর্ব সেই
হাসিতে যা কিনা একদিন আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল।
মস্কো, ২৯ জানুয়ারী ২০১৭
Comments
Post a Comment