মশা

আমার ছোট বেলায় মশারা ছিল বসন্তের কোকিলের মত, আসতো বছরের নির্দিষ্ট এক সময়ে। বর্ষার পর, যখন পথ হারিয়ে কিছু জল নদীর ঠিকানা না পেয়ে ডোবায় আটকে যেতো, আর গ্রামের কৃষকরা পাট পচাত ঐ ডোবায় পাটখড়ি  থেকে পাট আলাদা করার জন্য, ওখানে জন্ম নিত মশারা ফাও হিসেবে, আর মালিক শ্রেনীর পক্ষ নিয়ে শুষত মানুষের রক্ত। অবশ্য মশারা ছিল সাম্যবাদী, তাই মালিক-শ্রমিক সাবার রক্তই খেত নির্বিবাদে। আর যখন শীত আসতো তার কুয়াশার চাঁদর গায়ে দিয়ে, সাইবেরিয়ার পাখিরা যেমন বাংলাদেশে পালায়, মশারাও তেমনি পালিয়ে যেতো গ্রাম থেকে। ভুমিহীন কৃষকদের মত, যারা রুটি রুজির সন্ধানে শহরে চলে যায়, মশারাও চলে যেতো শহরে নর্দমার খোঁজে। তবে ইরিগেশনের সাথে সাথে  গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে ডোবা-নালা আর মশাদের হয়েছে পোয়াবারো। জল এখন সারা বছর থাকে বিধায় মশারা এখন গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা।
তাই ইদানিং দেশে গেলে মশাদের সাথে অলিখিত চুক্তি করে যাই। বলি,
“দেখ, আমার হাড্ডি কামড়িয়ে তদের দাঁত ভাঙ্গার দরকার নেই, বরং আশেপাশে যারা থাকবে, তাদেরই কামড়াস। আমি ওদের বলে দেব যে তোরা আমার মশা, তোদের যেন না মারে।“
এইতো কদিন আগে দেশ থেকে ঘুরে এলাম। বাড়িতে যত্ন করে মশারী টানিয়ে দেয়, আর আমার স্বপ্নগুলো মশারীর গায়ে হোঁচট খেয়ে চলে যায়। তাই মশারী ছাড়াই ঘুমাই। এমন এক সময়ে বেড়াতে এল কলকাতা থেকে কল্যানদা, সিডনী থেকে ভাইঝি ভ্রমর ওর দলবল মানে বর আর দুই ছেলেকে নিয়ে। ফাঁকা বাড়ি আবার লোকে লোকারণ্য, বিশেষ করে বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানের দিন। সবাইকে শোবার জায়গা দেয়াই কষ্ট। ভ্রমরের বর তপন বলল,
“কাকা, আমি আজ আপনার সাথে ঘুমাব।“       
“ঠিক আছে, চলে এস।“
বরাবরের মতই অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলাম। এক সময় ঘুমিয়েও পড়লাম দুজন। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি তপন হাওয়া। কি ব্যাপার। কোথাও নেই। আমি তো টেনশনে পড়ে গেলাম। শত হলেও বাড়ির জামাই। নাক ডাকি বলে কেউ কখনও  বলেনি, ঘুমের মাঝে ফুটবল খেলার অভিযোগ নেই। ঐ দিন বায়বীয় সমস্যাও ছিল না। এ এক মহা বিপদ, যতটা না তপনকে নিয়ে, তার চেয়ে বেশি নিজেকে নিয়ে, এমন কি করলাম যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল ও ওর মায়ের সাথে শুয়ে আছে। ওর ঘুম ভাঙ্গার পরে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে নিজেই বলল,
“কাকা, আপনার মনে হয় মশাদের সাথে কোন এগ্রিমেন্ট আছে। আপনি চুপচাপ ঘুমুলেন, আর মশাগুলো আমাকে আপনার ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল।“   
“ও বা, তুমি জানতে না, আমি মস্কো থাকতেই ওদের সাথে অলিখিত চুক্তি করে আসি? নেক্সট টাইম নিজেও করে এস, দেখবে মশারা একটুও ডিস্টার্ব করবে না।“


দুবনা, ১৮ জানুয়ারী ২০১৭   


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা