গোলক ধাঁধাঁ

আট বছর আগে এই ফেসবুকের পাতা ভরে গিয়েছিল ওবামামানিয়ায়, আজ সেই জায়গা নিয়েছে ট্রাম্পফবিয়া। ব্যাক্তিগতভাবে এতে আমার যে ঠাণ্ডা বা গরম লাগে, তা নয়, তবে যেহেতু লেখে বন্ধুরা, তাই এটা আমার মনে এক ধরনের কৌতুহলের উদ্রেক করে। তাই এই লেখা। যদিও আমি জানি, এতে আমার বন্ধুদের, ট্রাম্পের বা তার সমর্থকদের  অথবা ওবামা বা হিলারী বা তাদের সমর্থকদের কারোরই কিছু আসবে যাবে না। তবে যেহেতু ঘটনা ঘটে আর তার ফলে মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয় – তাই এই প্যাচাল পাড়া। বয়েস বাড়ছে। 
  
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ মেয়েদের। হ্যা, তার খোলামেলা কথাবার্তা, যেটা ফলাও করে প্রচার করেছে সংবাদ মাধ্যম, সেটা হয়াই স্বাভাবিক। তবে একই সময় যখন দেখি সেই লোকই বছরের পর বছর বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে, তখন ভেবে পাই না, কিভাবে একজন মানুষ যে নারীদের সৌন্দর্যের পুজারী, যে সেই সৌন্দর্যকে চার দেয়ালের ভেতর থেকে মুক্ত বিশ্বে নিয়ে আসে, সে কিভাবে নারী বিদ্বেষী হয়? আজ এমনকি রক্ষনশীল মুসলিম দেশগুলোতেও তাদের মত করে এই প্রতিযোগিতা হয়। তাই ট্রাম্পকে নারীমুক্তির এক দুত না বলে নারী বিদ্বেষী পুরুষ বলা – এর পেছনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি যুক্তি আছে, যেটা আমার জানা নেই, বা নিজে নারী নই বলে যেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার কেন যেন মনে হয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ওবামা, যে কিনা ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার কয়েক লক্ষ মানুষকে শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে, যার বা যাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় জন্ম নিয়েছে আই এস এর মত সন্ত্রাসী মৌলবাদী সংগঠন, তাদের তুলনায় ট্রাম্পের কাজকর্ম বাচ্চাদের দুষ্টুমির পর্যায়ে পড়ে।

আমি আমেরিকাবাসী নই, তাই তাদের আভ্যন্তরীন ব্যাপার সম্পর্কে কোন ধারনা নেই। তবে অনেক বন্ধুর লেখা থেকে মনে হয় ওবামার জামানায় আমেরিকা অনেক এগিয়ে গেছে – তা সে বেকারত্ব দুরেই হোক আর এলজিবিটি সোসাইটির অধিকার রক্ষায় হোক। তাহলে কি বলতে হবে ভদ্রলোক সেই ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইডের মত – যে দিনে এক রূপ ধরে, রাতে অন্য রূপ, যেমন ওবামা আমেরিকায় সৃষ্টির দুত আর বহির্বিশ্বে, বা অন্তত তার একটা বিরাট অংশে ধ্বংসের দুত?

সোভিয়েত জমানার শেষের দিকে গনতন্ত্রকে ভালো লাগত, অ্যামেরিকান গনতন্ত্র। অবাক হয়ে দেখতাম কিভাবে পরাজিত প্রার্থী অভিনন্দন জানাচ্ছে বিজয়ীকে, শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে ক্ষমতার হস্তান্তর। পরে বুঝালাম, এটাও পেপ্সি কোলার মত, আগে মার্কেটে ঢুকে অল্প পয়সায় ভালো পানীয় দেয়। আর এই প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন মার খেয়ে পাত্তা গোটায়, তখন এই সব কোম্পানী তাদের মনপলির রূপ প্রকাশ করে। আজ নির্বাচন পরবর্তী আমেরিকাকে দেখে আমার দেশের কথা মনে পরে। এতদিন পর্যন্ত আমরা শুধু উন্নত বিশ্ব থেকে আইডিয়া ধার করেছি। এবার ফেরত দেবার পালা। আমরা দিচ্ছিও। আমাদের দেখে দেখেই ওরা খোদ আমেরিকায় নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করছে, বাকী শুধু জ্বালাও পোড়াও। এমনকি নির্বাচনী প্রচারনায় কিভাবে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে হয়, সেটাও আমরা ওদের শিখিয়ে দিয়েছি। জীবনে অনেক বসন্তই তো দেখলাম, আরব বসন্ত, গোলাপ বিপ্লব, কমলা রঙের বিপ্লব আরও কত কি। তবে এটা আপাতদৃষ্টিতে কোন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে হলেও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে সিস্টেম, আর এই ঘোলা জলে মাছ ধরে এই সব বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাসী সাধারন মানুষ নয়, সেটা করে একেবারে ভিন্ন লোক, যারা থাকে পর্দার আড়ালে আর সময় মত বেরিয়ে এসে ক্ষমতা দখল করে। আর জনগন গনতন্ত্র বা সুন্দর ভবিষ্যতের পরিবর্তে পায় কান্না, ঘাম, রক্ত আর মৃত্যু।   

তবে কি ট্রাম্পের আমেরিকা থেকে আমাদের নেবার কিছুই নেই? নিশ্চয়ই আছে। এই তো কিছু দিন আগেও ওরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের বিরোধিতা করত, অকুণ্ঠ সমর্থন করত জামাত শিবিরকে। এখন ট্রাম্প মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছে। আমরা কি পারি না এই সুযোগটা ব্যাবহার করতে? এই সুযোগে জামাত শিবির সহ অন্যান্য মৌলবাদী দল থেকে আমেরিকার সমর্থন তুলে নেবার জন্য কাজ করতে। ট্রাম্প বা ওবামাকে আমার পছন্দ করতে হবে তার মানে নেই, তবে তাদের কোন কোন পদক্ষেপ যদি আমার দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ উচ্ছন্ন করতে সাহায্য করে, সেটা নিতে ক্ষতি কি?  

দুবনা, ৩০ জানুয়ারী ২০১৭  

ক্রিস্টিনার ছোটবেলা





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা