সেভার ১৪ বছর
আজ সেভার জন্মদিন। দেখতে দেখতে কেতে গেল দীর্ঘ ১৪ বছর। অথছ মনে হয় এই সেদিন নববর্ষের রাত কাটিয়ে গুলিয়াকে নিয়ে গেলাম রদ দমে, মানে ম্যাটেরনিটি হসপিটালে। গেলাম বরফ ভেঙ্গে, জানুয়ারীর কনকনে শীতের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে। আগে থেকেই সব ঠিক ছিল। ওই দিনই ডেলিভারি করাবে। ডাক্তার জানতে চাইলো, আমি উপস্থিত থাকতে চাই কি না প্রসবের সময়। সাহস পেলাম না, তাছাড়া বাসায় আন্তন, মনিকা আর ক্রিস্টিনা অপেক্ষা করছিল। ওরা তখন বেশ ছোট। রাতে ফোন করে জানলাম সেভা হয়েছে। নামটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সেদিক থেকে সেভা জন্মানোর আগেই ওর নাম জন্মায়। পরের দিন অখানে যাবার আগে গেলাম পাশের দোকানে। অখানে তাকা ফেলে পুতুল তোলার ব্যাবস্থা ছিল। গুলিয়া খেলতে বেশ ভালোবাসতো। এর মধ্যেই ঘরে শ তিনেক পুতুল জমে গেছিল। ভাবলাম দেখি আমিও পারি কি না। জীবনে এই প্রথম নিজে একটা পুতুল জিতলাম। পড়ে বাসায় ফিরে সবাইকে নিয়ে গেলাম হাস্পাতালে। রাস্তায় ক্রিস্টিনার সে কি বমি। এরি মধ্যে বরফের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে উপস্থিত সেভাকে দেখতে। গুলিয়াই দরজা খুলে দিল, জড়িয়ে ধরল ক্রিস্টিনাকে। এই প্রথম ক্রিস্টিনা মাকে ছাড়া রাত কাঁটালো বাসায়। সবচেয়ে অবাক করা যেটা ছিল, রাতে উথে ও মাকে ডাকল না, ডাকল পাপাকে। আমরা হাস্পাতালের সব বাধা নিষেধ অমান্য করে রাস্তার জামাকাপড় সহই ঢুকে পড়েছি গুলিয়ার কেবিনে। সেভা আমাদের দেখে একটু হেসে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। কিছুক্ষন পর সিস্টার এসে আমাদের এই তাবর মানে দল দেখে তার চক্ষু তো চড়ক গাছ। আমাদের তাড়াতাড়ি বিদায় করিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। দু দিন পরে আমি ওদের নিয়ে এলাম বাসায়। এর পর থেকেই সেভা আমাদের সংসারে পরিপূর্ণ ও সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মাস খানেক বাদে যখন জাগসে গেলাম ওর ডকুমেন্ট করতে, ভদ্রমহিলা বলল, “বারে তোমার আর তোমার ছেলের দেখছি একই দিনে জন্ম।“ প্রথমে একটু থতমত খেলেও ধাকাতা সামলে নিলাম। আমার জন্ম ২৫ সে ডিসেম্বর হলেও প্রাইমারী স্কুল শেষ যে সার্টিফিকেট দেয়, ছোট মাস্টারমশাই অতে লিখে দেয় ২ রা জানুয়ারী। আমিল তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও উনি ব্যাপারতা এড়িয়ে জান এই বলে যে চাকরী ক্ষেত্রে এতে কোন অসুবিধা হবে না। এতদিন পর্যন্ত ওটা ছিল আমার অফিসিয়াল জন্মদিন। আর আমার জন্মদিন পালন করতাম ২৫ শে ডিসেম্বর, তাই ২রা জানুয়ারীর কথা মনেই থাকতো না। তবে গত ১৪ বছর ২ রা জানুয়ারী আমাদের পারিবারিক অনুষ্ঠান, সেভার জন্মদিন।
এবার দেশ থেকে ফিরে দেখি ওর মুখে কেন যেন লাজুক লাজুক হাসি। আমি যখন দেশে জাই ও আমার চেয়ে কম করে হলেও দুই আঙ্গুল ছোট ছিল। ছোট বেলায় আমরা পাশাপাশি দাড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে মাপ্তাম কে বড় আর কে ছোট। তখন সেন্টিমিটারের হিসাব ছিল না – দুই আঙ্গুল, চার আঙ্গুল, আধ হাত – এসবই ছিল চারা খেলা, মারবেল খেলা, দারিয়াবাধা খেলার মাপের হিসাব, আর সেই সাথে নিজেদের উচ্চতা বা আপেক্ষিক উচ্চতা মাপার হিসাব। আমার বাবা তেমন উচা লম্বা ছিল না, ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি মত। আমিও এরকম বয়সেই বাবাকে ছাড়িয়ে যাই। তখনও নেপলিওনের উক্তি জানতাম না, বুঝতাম না যে আমি বাবার চেয়ে লম্বা ছিলাম, উঁচু ছিলাম না। টাই প্রথম যখন আবিষ্কার করি আমি বাবার থেকে লম্বা, কি একটা সংকোচ পেয়ে বসেছিল। বাবার পাশে দাঁড়াতে ইতস্তত করতাম। মাত্র এক মাস দেশে থেকে যখন ফিরলাম, ও আমার মাথা ছাড়িয়ে গেছে। নিজে তো অবাক হয়েছি, সেভা নিজেও কম অবাক হয় নি। টাই ওর এই লাজুক হাসি। বললাম “আয় তো দেখি, কে লম্বা আমাদের মধ্যে?” কি এক অজুহাত দাড় করিয়ে এরিয়ে গেল আমার প্রস্তাব। তবে সবাই যেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠে, ও ও ঠিক অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাছাড়া ও জানে গায়ে গতরে বড় হলেই বড় হওয়া যায় না, বড় হওয়ার মধ্যে লাভেরও কিছু নেই। তা না হলে জন্মদিনে দরকষাকষি করবে কেমন করে, দেশ থেকে এক গাদা জামাকাপড় নিয়ে আসার পরও বাড়তি দু তিন হাজার রুবল পেতে হলে কষ্ট করে হলেও বলতে হবে – পাপা দাই দেঙ্গি মানে বাবা টাকা দাও।
১৪ বছর ১৫ বা ২০ বা ২৫ নয়,
তবে নতুন রাশিয়ায় তার অন্য এক গুরুত্ব আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তরুণ-তরুণীরা ১৬ বছর বয়সে পাসপোর্ট পেত, তার মানে ওই সময়
থেকে নিজেদের কৃত কর্মের জন্য নিজেদেরই জবাবদিহি করতে হত। তবে ইএলতসিন এক পপুলিস্তি
স্টেপ হিসেবে ১৪ বছর বয়সেই রাশিয়ান ছেলেমেয়েদের পাসপোর্ট দেবার অথা ঘোষণা করে। তাই
এখন থেকে সেভার নিজস্ব পাসপোর্ট থাকবে।
মস্কো, ০২ জানুয়ারী ২০১৭
Comments
Post a Comment