পথভোলা পথিক

পাঠ্য পুস্তকে বানান ভুল, সেখান থেকে হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ দেয়া নিয়ে দেশে না হলেও ফেইসবুকে এক বিশাল আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেটা যতটা না মৌলবাদ বিরোধী, তার চেয়ে বেশী হাসিনা আর নাহিদ বিরোধী। আর এটাই শঙ্কার বিষয়।  
 "কালের কণ্ঠে" দেখলাম হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ ও বিএনপি-জামাত আমলের পাঠ্যসূচী ফিরিয়ে আনার জন্য তারা নাকি বিভিন্ন সময় আন্দোলন পর্যন্ত করেছে। এমন কি গত বছরের ৮ই এপ্রিল হেফাজত ইসলাম নাকি একটি বিবৃতি পাঠিয়ে পাঠ্য পুস্তক থেকে ১২ টি রচনা বাদ দেবার দাবী জানায়। বর্তমান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকার নাকি নিজেদের ২০১০ এর পাঠ্যসূচী ত্যাগ করে বিএনপি-জামাতের পাঠ্যসূচী গ্রহন করেছে।  
এ প্রসঙ্গে তরুন চক্রবর্তী লিখেছে

“মানুষের misconception দূর হওয়া দরকার। হেফাজতের বা ওলামা লীগের দাবীর কারণে বর্তমান আওয়ামী সরকার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামীকৃত করেছে- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। সত্য হল, বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস শেখ হাসিনার নিজেরই ইচ্ছার প্রতিফলন। সত্য হল, শেখ হাসিনা নিজেই একজন কট্টর ইসলামিস্ট, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক মানুষ। তাঁকে সর্বত্র- পাবলিক আসরে বা ঘরোয়া পরিবেশে ইসলামের জয়গান করতে দেখা যায়।
আওয়ামী সমর্থক প্রগতিবাদীদের এই misconception দূর হওয়া খুব বেশি দরকার কারণ তাঁরা আওয়ামী লীগকে একটি সেক্যুলার প্রগতিশীল দল গন্য করেন এবং এই দলের মাধ্যমে তাঁরা একটি সেক্যুলার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। সত্য হল, একটি সেক্যুলার, উন্নত, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে হলে একটি সত্যিকার সেক্যুলার নতুন দল গড়ে তুলতে হবে।“

তরুন নিজে আমাকে এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে কি ভাবছি সে বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল গত পরশু মস্কোর এক বাসায়। আমি বলেছিলাম, সব বিষয়েই যে আমার মতামত থাকতে হবে বা আমাকে মতামত দিতে হবে, তার কোন মানে নেই। এরপরে তরুনসহ আরও অনেকের লেখা পড়ে আরও দু কথা বলার প্রয়াস রাখি। আমি সেই গল্পের স্বাধীন মানুষ, এতটাই স্বাধীন যে আমার উপর পৃথিবীর কোন কিছুই নির্ভর করে না, এমন কি আমার ভাগ্যও না। এখানে আমি নিজেকে সেই ফটোগ্রাফারের টেক্সট বইএর গল্পটা বলি। যদি তোমার তোলা ছবি দেখে পাশের বাড়ির কুকুর লেজ নাড়ায়, তাতে তোমার ছবি খুব ভালো হয়েছে এটা ভাবার কারন নেই। তাই দেশের রাজনীতির ব্যাপারে আমার স্ট্যাটাস পড়ে যদি দু চারজন বন্ধু লাইক দেয়, তার অর্থ এই নয়, আমার কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বা এটা দেশের ইতিহাস বদলে দেবে। না, এটা অন্য কাউকে নিয়ে লেখা নয়, এটা নিজের সাধ ও সাধ্য সম্পর্কে আমার বাস্তব বুদ্ধি।
এখানে সিপিবি’র কমরেডদের কিছু কিছু স্ট্যাটাস পড়ে মনে হয়, তারা তাদের এককালীন সহযাত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে উদ্দেশ্য করে দুটো পাথর ছুঁড়তে পারলেই যেন খুশী। শুধু শিক্ষা সংক্রান্ত কেন, সিপিবির ইদানিং কালের সরকারবিরোধী সব আন্দোলন আমাকে পিকডোরের ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় নাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সমস্যা হোল, বর্তমানে তাদের শক্তি দিয়ে সিপিবি শুধু লাল কাপড় নাড়তেই পারে আর ষাঁড়ের মানে সরকারের গুঁতায় কুপোকাত হতে পারে। ষাঁড়ের গায়ে বর্শা বিঁধানোর ক্ষমতা না থাকায় দর্শক জনতা না দেয় তাদের হাততালি, না নামে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে। আমার মনে হয়, আজ আওয়ামী লীগের এই হেফাজত ঘেঁষা নীতি বাম দলগুলোর দুর্বলতারই প্রতিফলন।
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে যখন গনজাগরন মঞ্চ গড়ে উঠেছিল, আমরা সবাই আবার নড়েচড়ে বসেছিলাম, সারাদেশ নেমেছিল শাহবাগে। সবাই দেখেছিল নতুন প্রজন্ম কিভাবে ধারন করছে একাত্তরের চেতনা। তারপর সব ইতিহাস। হেফাজতের উত্থান, গনজাগরন মঞ্চের পতন। এমনকি শাপলা চত্বর থেকে পলায়নের পরেও ওরা আজ রাজনীতিতে সোচ্চার। গনজাগরন মঞ্চের মোকাবিলায় ওদের জন্ম। এর পর থেকে একের পর এক দাবী নিয়ে ওরা মাঠে নামছে। সরকার ওদের অনেক দাবী মেনেও নিচ্ছে। কই, জনজাগরন মঞ্চতো হেফাজতের দাবীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলছে না? কারণটা পরিষ্কার। একাত্তরের চেতনা বিরোধী মৌলবাদীরা ঐক্যবদ্ধ, আর এর পক্ষের শক্তি দ্বিধাবিভক্ত, বিচ্ছিন্ন। রাজনীতির শেষ কথা ক্ষমতা। যে জোট আপনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে, আপনাকে আপনার চিন্তাভাবনাকে, আপনার আদর্শকে বাস্তবায়ন করার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেয়, আপনি তার সাথেই গাঁট বাধেন। লেনিন নিজেও জার্মানির সঙ্গে প্যাক্ট করেছিলেন। এটা ব্যাক্তিগত কোন ব্যাপার নয়, শুধুই বিজনেস। তাই তরুনের সাথে একমত হয়েই বলতে হয় একটি সেক্যুলার, উন্নত, আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে হলে একটি সত্যিকার সেক্যুলার নতুন দল গড়ার কোন বিকল্প নেই। এই কথা বামেরা সেই ১৯৭৫ থেকেই বলছে, আর কি এক অজ্ঞাত কারনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সেটা করতে। মুক্তিযুদ্ধের বা একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক দল দেশের জন্য তো বটেই, আওয়ামী লীগের অস্ত্বিতের জন্যও খুব জরুরী। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সেটা গড়া যতটা সহজ, অন্য আমলে সেটা ততটাই কঠিন। তাই আসুন, শুধু সরকারের বিরোধীতার জন্য বিরোধীতা না করে একাত্তরের চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। একাত্তরের চেতনার পক্ষের শক্তিশালী আন্দোলন এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। একমাত্র এরকম আন্দোলনই যে ভবিষ্যতে একাত্তরের চেতনায় সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি বা বাহাত্তরের সংবিধান ফিরিয়ে আনতে পারে, এ ব্যাপারে আমার কোনই সন্দেহ নেই।

পুনশ্চঃ দেশে গেলে এখনও পার্টি অফিসে যাই পুরানো কমরেডদের সাথে দেখা করতে। তবে দল ভাঙ্গার পূর্ববর্তী পরিবেশ আর পাই না। এক সময়ের সংগ্রামের সাথীরা আর কমরেড নেই, কেউ হয়েছে বিলোপবাদী, কেউ-বা সংশোধনবাদী। যেন দলের এই ভাঙ্গনে নিজেদের কোন দায়ই নেই। আমার বিশ্বাস, এমনকি যখন সংসার ভাঙ্গে, সেখানেও স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কম-বেশি দোষ থাকে। প্রশ্নটা কে ভালো কে মন্দ সেটা নয়, পরস্পরের সাথে চলতে পারার অক্ষমতা। আমার মনে হয় একই ঘটনা ঘটেছে গনজাগরন মঞ্চের ক্ষেত্রে। এখানেও বাম দলগুলো এই ভাঙ্গনের জন্যে আওয়ামী লীগকে দায়ী করতেই ভালবাসে। এক্ষেত্রেও যে তাদের কৌশলগত ভুল থাকতে পারে, সেটা অন্তত মুখে বলে না। অনেককে বলতে শুনি, শিক্ষা মন্ত্রী কেন পদত্যাগ করে না? কিন্তু এতে কি সমস্যার সমাধান হবে? আমার যতদুর জানা আছে শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন উপদেষ্টা পরিষদে অনেক বাম ও প্রগতিশীল ঘরানার লোক আছেন। এই শিক্ষা মন্ত্রী গেলে ঐ জায়গাগুলোতে এরা থাকবেন না নিশ্চয়ই। প্রশ্ন আসতে পারে, কি দরকার এই সব বামদের, যদি না তারা অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যসূচী প্রনয়ন করতে পারে? পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকারেই বিভিন্ন লবি থাকে, কট্টরপন্থী, লিবারেল ইত্যাদি। যখন যে লবির শক্তি বেশি তখন তাদের পথেই চলে রাষ্ট্র। তারপরেও লবির দরকার, যাতে করে বিভিন্ন মত আর পথ নিয়ে কথা হয়, আলচনা হয়। আজকে কোন আইডিয়া গৃহীত হচ্ছে না বলেই সেটা নিয়ে কথা বলতে হবে না, তার কোন মানে নেই। আইডিয়া বাতাসে থাকা ভালো। একদিন ওটাই সবাইকে নাড়া দিতে পারে। আর তাই মন্ত্রীসভায় যদি কিছু বাম ঘরানার লোক থাকে তাতে এখন না হলেও আখেরে লাভ হতেই পারে।                


মস্কো, ৮ জানুয়ারী ২০১৭  


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা