চৌবাচ্চা

এক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে বই লিখি না কেন তার যুক্তি দেখিয়ে গতকাল এক স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম লেখক শিরোনামে। এটা ছিল নেহায়েত চুটকি। তবে রুশরা বলে সব চুটকির ভেতরেই কিছুটা চুটকি থাকে, বাকিটা সত্য। সোভিয়েত আমলে এভাবেই মানুষ প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করত। 

গতকালের স্ট্যাটাসে বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া আমাকে ভাবতে বাধ্য করল। মনে পড়ল এক যুগ আগের কথা। ২০১০ সালে আমরা মস্কোয় বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া নামে এক সংগঠন গড়ি। উদ্দেশ্য ছিল এখানে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করা আর সম্ভব মত দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করা। পরে এক পর্যায়ে বুঝলাম এখানে অনেকেই তারচেয়ে বেশি আগ্রহী বিভিন্ন পদে। তারাপদ রায় মনে হয় বলেছিলেন ও খুব গরীব, ওর টাকা ছাড়া আর কিছু নেই। সেই অভাব পূরণের জন্য অনেকেই এসব সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ইত্যাদি হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যদিও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল সেই সমস্যার সমাধান করার তবে অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রচুর।

এখন, বিশেষ করে একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে আমাদের মধ্যে লেখক হবার যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয় তা দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এটাও কি আমাদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকে বেরিয়ে আসার আরেকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা কি না। না, আমি লেখকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছি না, যে সব বই প্রকাশিত হয় তাদের সাথে আমি পরিচিত নই, তাই এসবের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই, কিন্তু অধিকাংশ লেখকের ক্ষেত্রে মনে হয় যদি বইমেলায় বই প্রকাশ না করতে পারি তাহলে জীবনটা ষোল আনাই মিছেক। আগে পাঠকেরা পূজা বা ঈদ সংখ্যার জন্য বসে থাকত আর লেখকরা এসব সংখ্যায় লিখে নিজেদের আগমনী বার্তা জানাতেন। কিন্তু এখন লেখকরা বইমেলার অপেক্ষায় থাকেন বই প্রকাশ করবেন বলে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু লেখকের লেখা পড়ে মনে হয় লিখতে পারেন বলেই এরা নিজেদের লেখক মনে করেন ঠিক যেমন স্বাক্ষর করতে শিখে অনেকেই স্বাক্ষর হয়ে ওঠে। মানুষ লিখবে, দেশে লেখকের সংখ্যা বাড়বে, সেটা ভালো কথা। কিন্তু এতে করে যদি ভাষার উন্নতি না ঘটে, যদি মানুষ শুদ্ধ করে দু লাইন বলতে বা লিখতে না শিখে তাহলে? বর্তমানে আমাদের বেশির ভাগ লেখক এক অদ্ভূত চৌবাচ্চা, এখানে জল ঢোকার নল নেই কিন্তু বেরুচ্ছে অনর্গল। মানে এরা পড়েন না শুধু লিখেই যান। 
এটা হয়তো বাজার অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু বাজার অর্থনীতি যেমন মানুষের মধ্যে মানবতার দুধে জল ঢালছে সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে সেটা করবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? আমরা যদি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই লেখকদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে, নিজ খরচে কয়েক শ'কপি বই ছেপে লেখকের খাতায় নাম লেখানো যায় কিন্তু সত্যিকারের লেখক হওয়া যায় না। লেখার স্বার্থেই লেখার গুনগত মানের কথা ভাবতে হবে। 

মস্কো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা