উত্তর

ভজন সরকারের পাঠানো উত্তরের-দেশে বইটি পড়লাম। অনেক দিন পরে এত দ্রুত (এক সপ্তাহ) কোন বই পড়লাম। আমি গল্পের বই পড়ি সাধারণত শোবার আগে। তবে ইদানিং নিজের পড়ার বই (গণিত ও পদার্থবিদ্যা, আর একটু লেখালেখি করি বলে ইতিহাস) এত সময় নেয় যে এর বাইরে তেমন একটা পড়া হয় না, পড়লেও একেকটা বই পড়তে মাস কাবার।

যেহেতু ভজন ক্যানাডা থাকে আর সেটা উত্তর গোলার্ধে তাই প্রথমে মনে হয়েছিল এটা ওর সেই জীবন নিয়ে লেখা। কিন্তু অনেকগুলো গল্পের সম্ভার এই বইয়ে বিভিন্ন এলাকাই স্থান করে নিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে ভারত ভাগের কথা ও দেশ থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভারত যাবার গল্প। উল্টোটা যে হয়নি তা নয়, তবে সেই সময়ের বেশির ভাগ বই হিন্দু লেখকদের লেখা তাদের দেশত্যাগের দুঃখের কথা জানিয়ে। হাসান আজিজুল হকের আগুন পাখি সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, যদিও আমার বিশ্বাস ওপার বাংলা থকে চলে আসা লোক বাংলাদেশে খুব কম নয়।

রেডিয়েশন দুই ধরণের - স্বতঃস্ফূর্ত, যা কিনা স্বেচ্ছায় ঘটে ও জোরপূর্বক, যা ঘটে বাহ্যিক বল প্রয়োগের ফলে। ইমিগ্রেশনও তাই। দেশ ভাগের সময় পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুদের চলে যাওয়া ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জোরপূর্বক, বাধ্য হয়ে। উল্টো দিকের দেশত্যাগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। অনেক সময় আবার তৃতীয় ধরণের হয়, তাড়িয়ে দিতে পারে বা বাধ্য হয়ে চলে যেতে হতে পারে সেই বিবেচনায় আগে থেকেই স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া। তবে দেশত্যাগে বাড়িঘর চলে গেলেও স্মৃতি তো আর ত্যাগ করা যায় না, ফলে সেই স্মৃতি, কখনও নিজের, কখনও পূর্বপুরুষদের কাছে শোনা, বারবার ফিরে আসে। ভজনের গল্পে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কারণে দেশত্যাগ করলেও সেই স্মৃতিটুকু একেবারে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই বার বার সেটা ফিরে ফিরে এসেছে।

আমাদের দেশের বাড়ি একই এলাকায়, মানিকগঞ্জে। তাই ও যখন ওর গ্রামের মানুষের রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার গল্প লেখে সেটা যেন আমার গ্রামেরই গল্প। ওর ভারত ভ্রমণ, কানাডার দিনলিপি - সবই উপভোগ্য। সব কিছুর মধ্যেই এক চাপা কান্না। এভাবে কত মানুষ যে তাদের নিজেদের মেধা দিয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারছে না এ কান্না সেই বেদনার কি? বর্তমানে সেটা আর শুধু হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পরে মুসলিম সম্প্রদায়েও, তারাও আজ ঘর বাঁধছে বিদেশে। কারণ একটাই। নিরাপত্তার অভাব। আজ শুক্তি আর জাহীদের ইন্টারভিউ দেখছিলাম। শুক্তি পাঠিয়েছে। এক পর্যায়ে ও বলল যখন এসএসসি বা এইচএসসির রেজাল্ট বেরুত আর পত্রিকায় স্ট্যান্ড করা ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপান হত ওর বাবা মোহাম্মদ সুলতান কষ্ট পেতেন এই ভেবে যে এরাও বাইরে ঘর বাঁধবে। এ থেকে মুক্তি আসবে যদি দেশে মানুষের জীবনের মূল্য দেয়া হয়, সব মানুষের জন্য সমান সুযোগের পরিবেশ তৈরি করা হয়।

উত্তরের অর্থ শুধু নর্থ নয়, আনসারও। ভজনের বই এখন শুধু প্রশ্নে ভরা, উত্তর নেই। আসবে কি কোনদিন?

দুবনা, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা