স্বর্গের ভেতর নরক



আমি মস্কো আসি ১৯৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ থেকে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরাই ছিলাম শেষ ব্যাচ। এয়ারপোর্টে বড় ভাইয়েরা নিতে এসেছিলো। ওখান থেকে সোজা ৬ নম্বর ব্লকে। প্রস্তুতি পর্বের ছেলেরা তখন সেখানেই থাকতো। যদিও রুমগুলো ছিল তিন জনের জন্য, থাকতাম আমরা চারজন করে। একজন সোভিয়েত আর তিন জন বিদেশী, সাধারণত বিভিন্ন দেশের ছেলেরা থাকতো এক রুমে যাতে নিজেদের ভাষার পরিবর্তে রুশ ভাষার কম্যুনিকেট করার চেষ্টা করে। এটা যে কাজে দিত, সেটা নিজেদের দেখেই বুঝতে পারি।
৬ নম্বর ব্লকে আমি ছিলাম ৩৫৩ নম্বর ঘরে। আমার রুমমেট ছিল সোভিয়েত মালদাভিয়ার কিশিনেভের আন্দ্রেই, ছিল দিল্লীর অরুণ, নেপালের বদ্রী। আমিই ছিলাম সব শেষে আসা। অরুণ আর আন্দ্রেই পড়বে ফিললজীতে, বদ্রী সাংবাদিকতায়। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এলেও ফিজিক্সে চলে যাবো সেটা ছিল নিশ্চিত। বদ্রী এর আগে তাসখন্দে কমসমলের ট্রেনিং এ এসেছিলো, রুশ ভাষা কিছুটা জানতো, তাই কয়েকদিন পরেই প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে রুম ছেঁড়ে চলে যায়। তাই আমরা কিছু দিন তিন জনেই ছিলাম, যদিও পরে আমাদের রুমে প্রদীপ নামে সুরিনামের এক ছেলে আসে।
এই রুমটা আমি কখনই ভালবাসতে পারিনি। আসার দুদিন পরেই যখন আন্দ্রেই একটা রুটিন তৈরি করে বলল কে কবে ঘর পরিষ্কার করবে, আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এটা ছিল এক বিশাল মানসিক পরীক্ষা। তাছাড়া আমি এর আগে সারা জীবন বাড়িতে কাটিয়েছি। এমন কি বুয়েটে যখন পড়তাম, ক্লাস থেকে হলে ফেরার পথে মানিকগঞ্জগামী মিনিবাস দেখলে প্রায়ই উঠে পড়তাম, চলে যেতাম বাড়ি আর খুব ভোরে এসে ক্লাস করতাম বাড়ি থেকে। যদিও আমাদের ঘরটা ছিল বেশ ফিটফাট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন  তবুও এই ঘরের উপর আমার ছিল যত রাগ, যেন এই ৩৫৩ নম্বর ঘরটাই আমাকে ধরে রেখেছে মস্কোয়, ফিরে যেতে দিচ্ছে না প্রিয় গ্রাম তরায়।     
প্রস্তুতি পর্ব শেষ হতে না হতেই আমি চলে যাই পাভলভস্কায়ায়। তখন ফিজিক্স, ম্যাথেমাটিক্স আর রসায়নের ছেলেরা সেখানে থাকতো, আর থাকতো কৃষিবিদ্যার ছেলেরা। আমি অনেক দিন পরে বাংলাদেশ থেকে গেছি ফিজিক্সে পড়তে, তাই ওখানে সমবয়েসী বাংলাদেশী আর ছিল না। কয়েকজন ছিলেন কৃষিবিদ্যায়, তবে অনেক বড়। তাই ওখানে থাকলেও আমি প্রায়ই চলে আসতাম মিকলুখো মাকলায়ায় বন্ধুদের কাছে। ঐ জায়গাটা ভালো বা মন্দ লাগার আগেই আমাদের   আবার ফিরিয়ে আনা হয় মিকলুখো মাকলায়ায় ২ নম্বর ব্লকে যেখানে ৫১০ নম্বর ঘরে আমি কাটাই ১৯৮৫ র ফেব্রুয়ারী থেকে ১৯৯৪ র মে পর্যন্ত। বছর দুই পরে, মানে ১৯৮৭ সালে যখন রুমা-সুস্মি প্লেখানভে থাকতে শুরু করে আর আমি হই ওদের নিত্য দিনের অতিথি, তখন মনে হতো বেশ হতো যদি আগের মতই পাভলভস্কায়ায় থাকতাম! সব চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ঘরটার কথা মনে থাকলেও ঘরের নম্বরটা এখন মনে নেই। আমার ঘরের সামনেই ছিল টেবিল টেনিসের বোর্ড। আমি, রানা, পার্থ, সঞ্জয় মিনশে প্রায়ই খেলতাম। আর মাঝে মধ্যে রানা, পার্থ আর বিশ্বরূপদা গিটার বাজিয়ে গান করতো
উহুমনা উহুমনা উহুমনা বলে ......
ওখানে থেকেই ফার্স্ট ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা দেই। পড়াশুনা ভালই করতাম, তাই আশা ছিল এক্সিলেন্ট রেজাল্ট হবে। মেকানিক্সের পরীক্ষা দিতে দিয়ে ভিস্কোসিটি শব্দটা ভুলে গেলাম, যদিও আকারে ইঙ্গিতে সব বুঝিয়েছিলাম। টিচার ৪ বসানোর সাথে সাথেই মনে পড়লো শব্দটা, কিন্তু উনি বললেন
-   খুব দেরি হয়ে গেল।
বিকেলে কথায় কথায় বিশ্বরূপদাকে বললাম
-   যাকগে, আমি তো সাবজেক্টটা জানি।
-   জানিস যদি, তবে পাঁচ পেতে সমস্যা কোথায়?
এ কথাটা পরে অনেক কাজে লেগেছে।
২ নম্বর ব্লকে কাটে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু। ওটা ছিল নিজেকে গড়ার সময়, ভালোলাগার, ভালোবাসার সময়। আজকের আমি, এটা ২ নম্বর ব্লকের ৫১০ নম্বর রুমের উত্তরসূরি। যদিও আমার পরে এক এক করে বেশ কিছু ছাত্র আসে দেশ থেকে আমাদের ফ্যাকাল্টিতে, তবে অন্য সব ফ্যাকাল্টির তুলনায় তা ছিল নগন্য। এর অবশ্য একটা ভালো দিক ছিল। এর ফলে আমার চলাফেরা শুধু বাঙ্গালী বা বাংলাদেশী আড্ডার মধ্যেই সীমিত ছিল না। ক্লাস শেষ লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করে চলে যেতাম বাংলাদেশীদের সাথে আড্ডা দিতে। বাসায় ফিরে সেটা চলত রুশ বা অন্য দেশী বন্ধুদের সাথে। ঐ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে ভালো চা বা কফি খুব একটা পাওয়া যেত না। আর আমার জন্য সব সময়ই ভালো ইন্ডিয়ান চা আর কফি পাঠাতো বাড়ি থেকে। ফলে আলেগ, আন্দ্রেই, ফিওদর, ইউরা ওরা সন্ধ্যায় আসতো আমার রুমমেট ইয়েভগেনির কাছে। চা খেতাম একসাথে, গল্প হতো বিভিন্ন রকমের। যেহেতু আমাদের ২ নম্বর ব্লকে নিয়ে আসে মেরামতের পরে, তাই ইচ্ছেমত রুমমেট বেঁছে নেয়া যেত। পড়াশুনায় ভালো করতাম বলে ফ্যাকাল্টিতে নাম ছিল, সুযোগ সুবিধাও ছিল। কিন্তু আমার কখনই মনে হয়নি রুমমেট বেঁছে নিতে হবে। আমার মত ইয়েভগেনিও পড়ুয়া ছেলে। তাই ও যখন বললো এক সাথে থাকার জন্য, কোন প্রশ্নই মনে জাগে নি। আমাদের সাথে আরও এলো রজার বলে মেক্সিকোর এক ছেলে। প্রথন দিনই নিজের ভুল বুঝলাম যখন ও আলমারিতে তালা ঝুলালো। রুমে ফিরতো রাত করে, এসেই শব্দ করে তালা খুলতো। কয়েক বছর পরে ও অন্য রুমে চলে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্য বন্ধুত্ব হয়নি। শুধু আমার সাথে নয়, কারো সাথেই ওর বন্ধুত্ব হয়নি। ও চলে গেলে আমাদের রুমে আসে তামিলনাড়ুর শ্রীকুমার। আমাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব থাকলেও কথা কম হতো। ও রুমে ফিরত গভীর রাতে যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, আর আমরা যখন ক্লাসে যেতাম ও ঘুমুতো। তাই দেখা হতো মূলত রবিবার। আর আমরা যখন পরীক্ষা শেষ করে বেড়াতে যেতাম, ও ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা দিতো। তবে বাইরের পড়াশুনা প্রচুর করতো। ছুটির সময়ে কুমার থাকলে আমি প্রায়ই ওকে নিয়ে সকালে দৌড়ুতে যেতাম আর যেতাম চার্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আর গভীর রাতে আরবাত ষ্ট্রীটে রক মিউজিক শুনতে। সেখান থেকে পুলিশ আমাদের চলে যেতে বলতো আর যারা গাইত ওদের ভাগিয়ে দিতো। এটাই ছিল সোভিয়েত জীবনে আরও একটা বাস্তবতা।  ২ নম্বরে থাকার আরেকটা সুবিধা হোল চাইলেই আমি একা হয়ে যেতে পারতাম যেটা কিনা যে সব হোস্টেলে প্রচুর বাংলাদেশী থাকতো সেখানে ছিল প্রায় অসম্ভব। পরে অবশ্য মাঝে মধ্যে আমার রুমেও আড্ডা হতো, বিশেষ করে মে’ ডে তে, যখন মস্কোর সব বাংলাদশী বন্ধুরা আসতো আমার ওখানে। সবার কাছ থেকে ১ রুবল করে নিয়ে আমি রুটি মাংস কিনে আনতাম, সাথে থাকতো পিভা। এই রুমে থেকেই আমি আমার মাস্টার্স শেষ করেছি, পি এইচ ডিও এই রুম থেকেই করা। মস্কোর শেষ দিন পর্যন্ত আমি এখানেই ছিলাম।
১৯৯৪ সালের ১৮ মে আমি জয়েন করি দুবনার জয়েন্ট ইন্সিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে। নতুন আবাস হয় সেখানে, যদিও মস্কোর একটা ফর্মাল ঠিকানা থেকেই যায় লেনিনস্কি প্রোসপেক্টের ৬৯ নম্বর বাড়ির ১০০ নম্বর ফ্ল্যাটে গুলিয়ার ওখানে ১৯৯৯ সালে রুশ নাগরিকত্ব পাবার পরে। তবে থাকা হয় নি। দুবনায় প্রথম দু বছর ছিলাম হোটেলে। ১৯৯৬ সালে ফ্যামিলি দুবনা এলে চলে যাই লেসনায়া ৫ এ। ১৯৯৯ থেকে থাকতে শুরু করি পন্তেকরভো ৫ এ। ২০০৯ সালে লেনিনস্কি প্রোসপেক্টের বাসা বিক্রি করলে ফর্মাল ঠিকানা হয় বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়ায়, তবে ২০০৯ সালেই মেট্রো স্পোরতিভনায়ার পাশে দভাতরা রোডে একটা রুম কেনে গুলিয়া। কিছুদিন আগে বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়ার বাসা বিক্রি করলে আমার ঠিকানা আবার বদলায়। গত ডিসেম্বরে এই প্রথম যাই দভাতরার বাসায়, উদ্দেশ্য আইডিয়া নেয়া ওখান থেকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে যেতে কতক্ষন সময় লাগবে। দুবনা থেকে আসার পথে আন্তনকে ফোন করলাম, ও বাসায় কি না আর আমি স্পোরতিভনায়া এলে ও আমাকে মিট করতে পারবে কি না। ও বাসায়ই ছিল। আমাকে নিয়ে গেলো। ঘরে ঢুকে আমার মনে হোল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরের যা তা অবস্থা। এক তলায় ঘর। অনেক পুরানো বাড়ি, জারের আমলের মনে হয়। গুলিয়া বলেছিল ঘরে কিছু জিনিষপত্র সরাতে যাতে বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়া থেকে জিনিষপত্র এখানে আনতে পারি। আমি ফোন করে বললাম, আমি এখানে থাকছি না। এখুনি বেরুচ্ছি।
এই বাসায় যখন আরেকটা রুম কেনে গুলিয়া বিভিন্ন যুক্তি দিতো। মেট্রোর সাথেই বাসা, সেন্ট্রাল এরিয়ায়, তাই পলিক্লিনিক, হসপিটালসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা অনেক। যেহেতু এই এলাকায় আমি এর আগে প্রচুর এসেছি, এখানে আমার বন্ধু দীপু পড়তো ফার্স্ট মেডিক্যালে, পাশেই আমার প্রিয় নভদেভিচি মনাস্তির, লুঝনিকি স্টেডিয়াম – তাই বাসা না দেখলেও আপত্তি করিনি। বাসায় ফিরলে গুলিয়া জিজ্ঞেস করলো                                            
-   কেমন দেখলে বাসা?
-   এক টুকরো নরকের মত।
-   কিন্তু চারিদিক স্বর্গের মত সুন্দর। একটু রিকনসট্র্যাকশন করলেই দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
-   আগে কর।
আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছিলো মনিকা-ক্রিস্তিনা এখানে থাকবে বলে। তবে স্বর্গের ভেতর এক টুকরা নরক এ কথাটা যেন মনে গেঁথে রইলো পরবর্তী কয়েকদিন। মনে পড়লো বিশাল উঁচু প্রাচীরের ভেতরে অট্টালিকায় বাস করা মানুষগুলোর কথা যারা দামী দামী গাড়িতে বাসায় ঢোঁকে আর বাসা থেকে বেরোয়, স্বর্গটা সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভয় পায় বাইরে বেরুতে পাছে নরকের দেখা মেলে। এরকম নিজ নিজ স্বর্গে বাস বর্তমান যুগের ফ্যাশান। তাই গুলিয়াকে বললাম
-   জানো, আমার কিন্তু এই নরকটাই ভালো লাগছে। চাবি তো আমাদের হাতেই। যখন খুশি স্বর্গে বেড়াতে যাবো, আর স্বর্গসুখে ক্লান্তি এলে আমাদের নরকে ঢুকবো। তাছাড়া হাল্কা চুনকাম করলে, দরজা বদলালে আমাদেরটাও দেখতে এক তারা স্বর্গ হয়ে যাবে।
হ্যাঁ তাই। নিজের ছোট্ট প্রাসাদে জীবন কাটালে দু দিন আগে হোক আর দু দিন পরে হোক, কুপমণ্ডক হয়ে যেতে হবে।এটা অনেকটা কচ্ছপের জীবনের মত। যেখানেই যাও নিজের ঘর সাথে করে নিয়ে যাও, আর মাথা বের করলেই হাজারো বিপদের সম্মুখীন হউ। তার চেয়ে অনেক ভালো যখন চারিদিকে মুক্ত আলো হাওয়া, পাখির ডাক, শিশুদের কোলাহল। আমার তো মনে হয় নরক বেষ্টিত স্বর্গের থেকে স্বর্গ বেষ্টিত নরক অনেক ভালো। অংকও তাই বলে। গড়পড়তা হিসেব নিলে নরক বেষ্টিত স্বর্গের নরকত্ব যে হারে বাড়ে, ঠিক সে হারেই বাড়ে স্বর্গ বেষ্টিত নরকের স্বর্গত্ব।
আমার বউ কিছু করে তারপর তার জন্য অজুহাত খোঁজে আর আমি সেটাকে খণ্ডন করি। এই প্রথম আমিও তার কাজের সপক্ষে যুক্তি খুঁজছি।  

দুবনা, ০৬ জানুয়ারী ২০১৮    

        

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি