মৃত্যুর রং



মৃত্যু ব্যাপারটাই রহস্যজনক। কারণ একটাই, আমরা জানি না মৃত্যুর পর কি? তাই এ নিয়ে নানা মত, নানা পথ আর সেই সাথে ভয়। তবে এটা ঠিক মৃত্যু পার্থিব জীবনের শেষ, যার পরে থেকে যায় শুধু স্মৃতি, কিছু দীর্ঘশ্বাস আর “যদি ও বেঁচে থাকতো তবে...” এ রকম অনেক ধরণের উক্তি। কোন মৃত্যুতে আমরা কষ্ট পাই, কোন মৃত্যুতে হই খুশি। আর সেটা নির্ভর করে যে মারা গেলো তার সামাজিক অবস্থান আর প্রতি আমাদের মনভাবের উপরে।  মৃত্যু অনেকটা ডার্ক এনার্জির মত। ডার্ক এনার্জি আমাদের পরিচিত কোন কিছুর সাথে সরাসরি ইন্টারঅ্যাক্ট করে না, তাই তা সম্পর্কে আমরা যাই জানি সেটা তত্ত্বীয়, বিভিন্নভাবে ভাবে তার প্যাসিভ উপস্থিতি থেকে আমরা অস্তিত্ব প্রমান করি কারণ আমরা জানি এই ঘটনা ঘটার জন্য এই উপাদান দরকার। কিন্তু সেটা আমরা দেখছি না, তবে ঘটনাই প্রমান করে তার উপস্থিতি। এটা অনেকটা অদৃশ্য শক্তির কালো হাতের মত। সেভাবে বলতে গেলে অনেক মানুষ যারা বহু আগে গত হয়েছেন তারাও আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেন, প্রভাবিত করেন আমাদের জীবন। সেটা হবে পারে ধর্মীয় নেতা, দার্শনিক, লেখক, কবি বা অন্য কেউ। তবে আজকের কথা সে বিষয়ে নয়।

ছোট বেলায় আমার ঠাকুরমা মারা যান, তবে যেহেতু উনি বরাবরই অসুস্থ ছিলেন, ঐ মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করেনি। যুদ্ধের সময় কিছু মৃত্যু দেখলেও সেটা ছিল অপরিচিত মানুষের মৃত্যু। ১৯৮৩ সালে রাশিয়ায় আসার আগ পর্যন্ত বাড়িতে কেউ মারা যায়নি, তাই মাখন মাস্টারমশাইকে বাদ দিলে মৃত্যুকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হয়নি। শেখ মুজিবের মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল বটে, তবে সেটা ছিল ভিন জাতীয়, অস্বাভাবিক। যখন মস্কো আসি পড়াশুনা করতে তখন একে একে এ দেশের অনেক নেতাই মারা যান, ব্যথিত হই। প্রায় দশ  বছরের ভার্সিটি লাইফে বেশ কয়েকজন শিক্ষক হারাই – তবে সেটা ছিল কালেভদ্রে, অকস্মাৎ। পরিবর্তন শুরু হয় দুবনা আসার পর। মনে পড়ে, ১৯৯৪ সালে কাজে জয়েন করার পর প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ মারা যেত, গেটের সামনে বোর্ডে সে খবর থাকতো। সময়টাই ছিল তেমন, রাশিয়া যেন মৃত্যু উপত্যাকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কোন পথে যাবে – সোভিয়েত ইউনিয়নের মতই অব্লিভিওনে না কি ঘুরে দাঁড়াবে জীবনের দিকে, লড়াই করবে নতুন করে বাঁচার জন্য।
আমি প্রথম পাঁচ বছর ছিলাম থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স ল্যাবে, পরে আই টি ল্যাবে চলে আসি যদিও কাজ করছি আগের মতই। এখানে প্রায় সবাইকে আমি চিনি, কাউকে নামে, কাউকে চেহারায়, খুব কম লোকের নাম ও চেহারা একসাথে জানি। তাই কয়েক বছর আগে বন্ধু অসভালডো যখন বলল পাশনেভ নিখোঁজ হয়েছে, পড়লাম বিশাল ঝামেলায়। কেনন না আমি জানতাম ওকে চিনি কিন্তু মনে করতে পারছি না কে? আমাদের ইন্সটিটিউট থেকে সবসময়ই প্রচুর লোকজন বিভিন্ন দেশে যায় কাজ করতে, কেউ অল্প সময়ের জন্য কেউ বা দীর্ঘমেয়াদী ভিজিটে। তাই অনেক দিন কাউকে না দেখলে আমার মনে হতো এটাই পাশনেভ। আর এক সময় যখন সে লোক ফিরে আসতো, ওর নাম মৃত বা নিখোঁজদের লিস্ট থেকে কেটে দিতাম। শেষ পর্যন্ত এক বছর পরে যখন পাশনেভের নিখোঁজ হওয়া উপলক্ষ্যে একটা স্মরণ সভার আয়োজন করে, সেখানে ছবি দেখে আমি চিনতে পারি ওকে। পরিচিত। দেখা হলে সব সময় কুশল বিনিময় করতাম। মাঝে মধ্যে দু একটু কথাবার্তাও হতো, যেমন এখন বাংলাদেশে কেমন ওয়েদার। দুবনায় আমাদের প্রায় সব গেটেই ডাবল দরজা আর এখানে প্রায় সবাই দরজা ধরে সাথের লোককে যেতে দেয়। আর সবাই ডাবল দরজার সুযোগ নেয়, মানে কেউ আমাকে আমার জন্য প্রথম দরজা ধরলে আমি তাকে দ্বিতীয়টা খুলে দেই। আমি ঠাট্টা করে বলি – “জানো, ছোট বেলায় শুনেছি যে প্রথমে সালাম দেয় সে পায় ১০ মার্ক আর যাকে নেয় সে ৫। আর যখন দ্বিতীয় জন সালাম ফিরিয়ে দেয় তখন সে পায় ১০, অন্যজন ৫। ফলে সবাই ১৫ করে পায়। তোমাদের দরজাগুলো মনে হয় স্বর্গের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে।“ আমি আর পাশনেভ অনেক বারই একে অন্যেকে (স্বর্গের?) দরজা খুলে দিয়েছি।
হঠাৎ এসব কথা কেন? অনেকদিন বন্ধুদের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না, শুধু বন্ধুদের কেন, কারো সাথেই না। সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে সেটা হয়েছে। এখন আমরা সবাই আগের মতই কাছে চলে এসেছি। যোগাযোগ স্থাপনের প্রথম দিকে ছিল নিজেদের খবর, নিজেদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খবর। ছবি আসতো ফেসবুকে। দেখা হতো পিকনিকে (যারা যায়)। এরপর এলো বিয়ের সময়, ছেলেমেয়েদের। প্রায়ই দেখি কারো ছেলে বা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে বিশাল সমাবেশ। ইদানীং নতুন পর্বের শুরু। এক এক করে বন্ধুরা অন্য জগতে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদায়ী সমাবেশ হচ্ছে আরও একটা মিলনকেন্দ্র।              
গতকাল ফেসবুকে বন্ধু জয়নালের পোষ্ট দেখলাম। খালেক ভাই মারা গেছেন। খারকভের ১৯৭৩ সালের ব্যাচ। এটা আমাকে কিছুই বলে না। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ছেলেমেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পরবর্তীতে রাশিয়ায় পড়াশুনা করেছে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত যারা এসেছে তাদের একটা বিরাট অংশকে চিনলেও অপরিচিত লোকের সংখ্যাই বেশি। তাই গতকাল থেকে আমার সেই পাশনেভ পরবর্তী অবস্থা। আমি এক খালেক ভাইকে চিনতাম। উনি মানিকগঞ্জের। দেশে থাকতেই আলাপ ছিল। উনি তখন উথুলি সরকারি হাসপাতালে বসতেন, আমি মাঝেমধ্যে যেতাম। সোভিয়েত দেশের গল্প শুনতে। গেলেই উনি সিপিবির জন্য ৫০০ করে টাকা দিতেন। ওনার ভাই পড়তেন মস্কোয়। অমলদাদের বন্ধু।  কেমিস্ট্রিতে পড়তেন। মালেক ভাই। এখন আমেরিকায় আছেন। মস্কোয় থাকতেন সায়েন্স অ্যাকাডেমির হোস্টেলে। গিয়েছি বেশ কয়েকবার।  এখন ওর থেকে একটু দূরে আমাদের বাসা। ওদিক দিয়ে গেলেই মনে পড়ে মালেক ভাইয়ের কথা।  খালেক ভাইয়ের মেয়ে রিয়া বর্তমানে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। খালেক ভাইয়ের শেষ দেখা ২০১৪ সালে, ঢাকার রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আমার ছবি প্রদর্শনীতে। কথা ছিল মানিকগঞ্জে ওনার বাসায় যাবো। সময় মেলাতে পারিনি।  আর কোন খালেককে মনে করতে পারছি না। অথচ জয়নাল যে এই খালেক ভাইয়ের কথাই লিখেছে সেটাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না। এজন্যেই মনে হয় মৃত্যু সংবাদ দেবার সাথে সাথে ছবি দেয়ার রেয়াজ। আশা করি জয়নাল বা অন্যেরা পরবর্তীতে এটা মাথায় রাখবে।
এক সময় মৃত্যুকে খুব ভয় করতাম। এখন করি না। লেভ তলস্তয় বলেছেন “একবার এড়ানো যায় না, কিন্তু দু বার মরা যায় না।“ শক্তির নিত্যতার সুত্র অনুযায়ী আমরা সবাই শক্তিতে পরিণত হবো, ইলেকট্রন, প্রোটন, ফোটন হয়ে ঘুরে বেড়াবো মহাবিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কোন পাসপোর্ট লাগবে না, ভিসা লাগবে না, ঘুরে বেড়াবো আলোর কাঁধে চেপে, স্বাধীনভাবে।

শুভ যাত্রা।

দুবনা, ২৭ জানুয়ারী ২০১৮                


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি