মস্কোয় একদিন
গতকাল মস্কো গেলাম। ২০১৮ সালে এই প্রথম। একটা কাজে। গত সেপ্টেম্বর থেকেই ইউনিভার্সিটিতে কাজ করছি, ওটাকে এখনও অফিসিয়াল রূপ
দেয়া হয়নি। গতকাল গেলাম
কাগজপত্র জমা দিতে। আমাকে কে যেন বলেছিল ক্যাডার নিয়ে যারা কাজ করে ওদের অফিস খোলা থাকে
সপ্তাহে তিন দিন সোম, বুধ ও শুক্রবার। বেলা দুটোর পর থেকে। তাই দুবনা থেকে রওনা দিলাম ধীরে সুস্থে। ব্লা ব্লা কার ছাড়ল সকাল
৯ টায়।
- তোমার শেষ
গন্তব্য কোথায়?
জিজ্ঞেস করলাম ড্রাইভারকে।
- আমি যাবো
বারিকাদনায়া, চিড়িয়াখানার পাশে। তবে তোমাদের তিমিরিয়াজভস্কায়া মেট্রোতে নামিয়ে দিতে পারি।
- আমার একটু কাজ
আছে ফরেন মিনিস্ট্রির পাশে।
চিড়িয়াখানার
পাশেই তো প্রেস্নের স্কাইস্ক্রাপার, তার পাশে অ্যামেরিকান দুতাবাস, একটু পরে নিউ
আরবাত, গভর্নমেন্ট হাউস, তার পরেই ফরেন মিনিস্ট্রি সব মিলে ১৫ মিনিটের পায়ে হাঁটা রাস্তা। দেখি, যদি জ্যাম না থাকে,
আমি বরং তোমার সাথেই চলে যাবো।
- ঠিক আছে।
রাস্তার অর্ধেকটা গেল বই পড়ে (আমি রাস্তায় বই পড়তে পছন্দ করি, কেন না এই
সময়টাকে কাজে লাগানোর এটা হাতে গোনা কয়েকটা উপায়ের একটা)। বাকী পথ গেলাম ঘুমিয়ে। ইদানীং প্রায়ই ঘুম পায় দিনের বেলায়। আগে এটা হতো না। বাড়িতে সবাই ঘুমুত (দেশে,
এখানে), আর আমি বসে বসে কিছু একটা করতাম। এটা হয়তো হছে শরীরের বয়েস বাড়ছে বলে।
সাভিওলভস্কায়া থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে চলে গেলাম। অনেকদিন বেলারুস্কায়া আসিনি। নতুন করে ঢেলে সাজানো সব। গোর্কির স্ট্যাচুটা নতুন
করে বসিয়েছে। যেতে যেতে মনে
হল ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে আসতে হবে এসব জায়গার। শেষ পর্যন্ত ১০.৪৫ এ এসে পৌঁছুলাম চিড়িয়াখানার
পাশে। দূর থেকে
প্রেস্নের স্কাইস্ক্রাপার দেখা গেলেও নামার পর সেটা হারিয়ে ফেললাম। তবে গভর্নমেন্ট হাউস দেখা
যাচ্ছিল দূরে, তাই সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। একটু পরেই চোখে পড়লো চিড়িয়াখানা। মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে
ছোট ব্রীজ যা চিড়িয়াখানা দুই অংশকে যোগ করেছে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি পুকুরে হাঁসেরা নাইছে। একটু এগিয়ে হাতের ডান
দিকে পড়লো ক্রাস্নপ্রেস্নেন্সকায়া মেট্রো। ওখানে আগে আসতাম সিনেমা দেখতে। বাঁ দিকে মেট্রো বারিকাদনায়া। চিরচেনা পথ দিয়ে এগুলাম
সামনের দিকে। প্রেস্নের
স্কাইস্ক্রাপার রোদে ভেসে যাচ্ছে। আমি সাদভায়া কালৎসোর (গার্ডেন রিং) বাইরের দিকে। রাস্তা পার হলেই পড়তো কচালভা স্ট্রিট যেখান
থেকে ছাত্র জীবনে পুরানো বইয়ের দোকানে ইংরেজি বই কিনতাম। আমার ইংরেজি গল্পের কালেকশন ওখান থেকেই করা। দ্বিজেন কাকু প্রায়ই আমায়
সংগ দিতেন। আরেকটু এগিয়ে গেলে
পড়তো মায়াকভস্কি থিয়েটার আর থিয়েটার নিকিতস্কিখ ভারোত। পরের থিয়েটারটা খুব প্রিয় ছিল আমার। মার্ক রজোভস্কি এর প্রধান। উনি সব সময় একটু অন্য রকম
করে ইন্টারপ্রেট করতেন সবকিছু। আমি দস্তয়েভস্কির লেখা নিয়ে কিছু পেলেই চলে যেতাম মস্কোর বিভিন্ন থিয়েটারে
– তা সে তাগানকা, এমখাট, লেনকম, মসসোভিয়েত যাই হোক, তবে রজোভস্কি ছিল একেবারে
ভিন্ন ধরনের। মনে মনে এসব
ভাবতে ভাবতে আমি মোড় নিলাম হাতের ডান দিকে। বাঁ দিকে গেলে পড়তো কাবুল নামে দোকান যেখানে রুমা আর
সুস্মির সাথে যেতাম টুকিটাকি কেনাকাটি করতে। তারপর প্ল্যানেটোরিয়াম, পাকিস্তান দুতাবাস ইত্যাদি
ইত্যাদি। শেষ এ এলাকায়
এসেছি ২০১৩ সালে সেভা আর ক্রিস্তিনাকে নিয়ে চিড়িয়াখানা আর প্ল্যানেটোরিয়াম দেখতে।
এখন এসব জায়গা অনেক বদলে গেছে। নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল অ্যামেরিকান দুতাবাস। তার আগে একটা বাড়ি দেখে
অবাক লাগলো। ওর সামনে
কয়েকটা বাচ্চা নিয়ে দুজন মধ্য বয়েসী মহিলা দাঁড়িয়ে। দূর থেকে ভাবলাম জিপসি, কাছে এসে বুঝলাম
স্কুল থেকে এসেছে। কাছে গিয়ে দেখি এটা ফিওদর শালিয়াপিনের বাসা – ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার মত নামকরা
গায়ক। সোভিয়েত আমলে
বাড়িটা এতো যত্ন আত্তিতে ছিল না, তাই হয়তো মনে নেই। তারপর অ্যামেরিকান দুতাবাস। ঠিক পরের বাড়িটা ছোট্ট
সুন্দর এক বিল্ডিং, দেখেই বোঝা যায় ইদানীং কালে চুনকাম করা হয়েছে। এটা বিখ্যাত লেখক ও
কূটনীতিবিদ গ্রিবোয়েদভের বাড়ি। উনি পুশকিনের সমসাময়িক, পারস্যে মারা যান। এই দুই বাড়ির মাঝে অ্যামেরিকান দুতাবাস খুব
বেমানান লাগছিল। এটা শুধু দুটো ছোট বাড়ির মাঝে বিশাল বাড়ি বলেই নয়। এতক্ষন পর্যন্ত এই পায়ে হাঁটা পথ ছিল
প্রশস্ত, আলো ঝলমল। এখানে হঠাৎ দেখলাম দুতাবাসের ঠিক গা ঘেসে অনেকগুলো বিশাল বিশাল সিমেন্টের
ব্লক বসানো। ওরা যেন বলছে সাবধান, কাছে এস না। গ্রীষ্মে ফুল লাগালে এগুলো টবের মত মনে হলেও
এখন, এই শীতে ওগুলোকে অ্যান্টিডেমনস্ট্রেশন ব্লক বলেই মনে হচ্ছিলো। আবার মনে হল অর্থ আর
ক্ষমতার কথা। আমরা যত বেশী
বিত্তশালী, যত বেশী ক্ষমতাবান হই, নিজেদের তত বেশী আইসোলেট করে রাখি। হয়ে যাই সোনার খাঁচায়
বন্দী বিলিয়ন ডলারের পাখী। কিন্তু যতই সোনার হোক না কেন, যতই মনিমানিক্য লাগানো থাক না কেন, জেল জেলই। অর্থ ক্ষমতা আমাদের অন্যের
কাছ থেকে স্বাধীন করে বটে, কিন্তু দিনের শেষে আমরা এই অর্থ আর ক্ষমতার দাস বনে যাই।
একটু এগিয়ে চোখে পড়লো নিউ আরবাত। অক্টোবর সিনেমা হল আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, আমিও হাত
নেড়ে ওকে স্বাগত জানালাম। সেই বিখ্যাত গ্লোবটা দেখে মন ভরে গেল। আমি রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম ভেতরের দিকে। সামনে স্মলেন্সকায়া
মেট্রো। এর পর ফরেন
মিনিস্ট্রি। রাস্তার উলটো
দিকে গোল্ডেন রিং হোটেলের দুই বিল্ডিং। আগে এর নাম ছিল হোটেল বেলগ্রাদ। ফরেন মিনিস্ট্রি পেছনে রেখে চলে গেলাম একটা
অফিসে যেখানে কিছু ডকুমেন্ট দেখানোর দরকার ছিল। কাজ শেষে দেখি ১২ টা বাজে। “আচ্ছা, অনেকদিন তো
ক্রিমস্কি ব্রীজে হাঁটা হয় না। কেমন হয় গেলে?” মনে পড়লো ১৯৮৬ সালের কথা। আমরা তখন প্রায়ই আসতাম গোর্কি পার্কে। একদিন আমি আর আমার রুমমেট
কুমার দাঁড়িয়ে ছিলাম ট্রলি বাসের জন্য। যাবো আরবাত। হঠাৎ বেশ কিছু স্কুলের ছাত্র এসে চড়াও হল আমাদের উপর। পরে ওদের নিজেদের মধ্যেই
ঝগড়া আমাদের মারবে কী মারবে না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়িরা ওদের একটু ধমকিয়ে আমাদের বললেন
- তোমার হেঁটে
চলে যাও। ওরা অল্প
বয়েসি। কথা শুনবে না।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম নদীর ওপার। শেষ যখন এই ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটি মনে হয়
১৯৯২ সালের শীতের রাতে। প্লেখানভ থেকে আমি আর তমাল বাসায় ফিরছিলাম।
- চল হাঁটি পার্ক
কুলতুরী পর্যন্ত।
- চল।
তখন যৌবন। রক্ত গরম। ভালবাসা আর স্বপ্নে হৃদয় মন সব ভরা। হঠাৎ তমাল আমার মাথা থেকে টুপি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তাকিয়ে দেখি নদীতে পড়েনি। দৌড়ে নীচে নেমে নিয়ে এলাম
টুপিটা। এসব কথা ভাবতে
ভাবতে হাঁটতে লাগলাম মস্কো নদীর দিকে। জুবভস্কি বুল্ভারে এসে তাকালাম ডান দিকে।
সেখানে রাশিয়ার চেম্বার অফ আকাউন্তস। ঐ
পথে হাঁটলে সামনে পড়বে বাংলাদেশ দুতাবাস। ১৯৯২ সালে যখন দুতাবাস স্কুলে কাজ করতাম,
এ পথেই যেতাম। ফেরার সময় সাথে থাকতেন কাকু, মানে দ্বিজেন শর্মা। কখনো চলে যেতাম
তলস্তয়ের বাড়ি। সামনের দিকে এখনো দাঁড়িয়ে প্রগতি প্রকাশন। প্রায়ই আসতাম - একা, কাকুর সাথে বা বন্ধুদের
নিয়ে। সোভিয়েত জীবনে প্রগতির বাংলা বই আমাদের কাছে ছিল বদ্ধ কামড়ার জানালার মত।
তখনও রুশ ভাষায় বইপত্র তেমন পড়তে পারতাম না। বাংলা বলতে ছিল দেশ থেকে আসা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা “একতা” আর প্রগতি প্রকাশনীর বই। আমরা যারা সোভিয়েত
ইউনিয়নে পড়তে এসেছিলাম তাদের অধিকাংশই ছিলাম বাম ঘেঁষা রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউণ্ড
থেকে। ফলে দেশে থাকতেই প্রগতির বইয়ের সাথে পরিচিত ছিলাম। ইদানীং প্রায়ই এ এলাকায়
আসছি, আর সব সময়ই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন কাকু। কথা বলি মনে মনে – কত কথা, তার কী কোন
শেষ আছে? মৃত মানুষের সাথে কথা বলার এই এক সুবিধা – কথোপকথন চলে নিজের ইচ্ছেমত,
এমনকি প্রশ্ন উত্তর সবই নিজের মত। তবে সে জন্যে যার সাথে কথা বলছি তাকে জানতে হয়,
বুঝতে হয়, তার মনের সাথে, তার চিন্তা চেতনার সাথে নিজের মন আর চেতনাকে একই সুরে
বাঁধতে হয় – অনেকটা গানের আগে হারমোনিয়াম আর ডুগিতবলার গৎ বাঁধার মত। কাকুর সাথে
কথা বলতে বলতে চলে এলাম মস্কো নদীর মাঝামাঝি। আকাশে রোদের হাসি। সে হাসিতে ঝলমল করছে ক্রাইস্ট দ্য সাভিওর চার্চের চুড়া,
আরও দূরে ক্রেমলিনের আরখানগেলস্কি চার্চের চুড়া জানিয়ে দিচ্ছে তার উপস্থিতি। নদী পার হয়ে এলাম
ক্রিমস্কি ভালের ত্রেতইয়াকভ গ্যালারির সামনে। অনেক আগে ১৯৯৪ সালে মনিকা জন্মের মাত্র
কয়েকদিন আগে তপু এসেছিল মস্কো। তখন সেখানে চলছিল দালির প্রদর্শনী। বিশাল লাইন। এখানে প্রেগন্যান্ট মহিলাদের সব জায়গায় অগ্রাধিকার, তাই
গুলিয়াকে সাথে নিয়ে গেলাম সেই প্রদর্শনীতে। মনে হল যেন সেদিনের কথা। ওখানে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করবো। সোজা চলে যাবো
অক্টোবরস্কায়া মেট্রোয় নাকি ঢুকবো গোর্কি পার্কে? এটা আমাদের যৌবনের প্রিয় জায়গা। জালালের সাথে যেতাম
প্রায়ই। তাছাড়া
বিভিন্ন উৎসবে, বিশেষ করে ৯ মে বিজয় দিবসে যেতাম সেখানে সবাই মিলে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের হাজার
হাজার ভেটেরান আসতেন এখানে। ফুল দিতাম, ছবি তুলতাম। এখানে শেষ আসি মনে হয় ১৯৯৬ সালে যখন আন্তন, মনিকা খুব ছোট। অনেক দিন পরে এখানে ঢুকে
নস্টালজিক লাগলো নিজেকে। হুড়হুড় করে একে একে স্মৃতিগুলো ভির করে আসতে লাগলো মনের বায়োস্কোপে। এখন শীত, তাই পার্ক বলতে
গেলে জনশূন্য, শুধু ঘেরা জায়গায় স্কেটিং করছে লোকজন। আমি সারা পার্ক পেরিয়ে বেরুলাম লেনিনস্কি
প্রোসপেক্টে। রাস্তা ক্রস
করে যাচ্ছি সাব্লভস্কায়ার দিকে, মনে পড়লো পাশেই প্রেমের অফিস। কল দিলাম।
- বিজনদা, চলে
আসেন চা খেয়ে যান।
- ঠিক আছে। কিন্তু সময় একেবারেই নেই।
প্রেমের ওখানে বসে কথা বলছি।
- এখন এক মহিলা
আসবেন আমার অফিস দেখতে। এখানে সব সময় নিরিবিলি, কোন হৈচৈ নেই, অথচ এক মহিলা সব সময় আসে বিভিন্ন
অভিযোগ নিয়ে। কি যে মুস্কিল।
- তোমার কথা শুনে
মনে হয় শান্তিই অশান্তির মুল। তুমি যে শান্তিতে আছ, ঐ ভদ্রমহিলা সেটা সহ্য করতে পারছেন না, তাই এতো
ঝামেলা।
ইউনিভার্সিটিতে এসে দেখি ইউরি প্রিগরিভিচ বসে আছেন।
- শুভ নববর্ষ।
- শুভ নববর্ষ।
ইউরি পেত্রোভিচ তোমার জন্য এই কাগজগুলো রেখে গেছেন। এগুলো নিয়ে তোমার মিকলুখো মাকলায়া
যেতে হবে।
- হ্যাঁ, জানি।
আমি খেয়ে আসছি। তারপরেই চলে যাবো।
আচ্ছা ট্রামে গেলে কেমন হয়? লমনোসভস্কি প্রসপেক্ট থেকে ট্রলি বা বাসে করে ওখান
থেকে যাবো টুরিস্ত বিল্ডিঙে? এ পথেই তো আসতাম ছাত্র জীবনে। ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে
রইলাম ট্রামের জন্য। কিন্তু ট্রামের পাত্তা নেই। হাঁটতে শুরু করলাম লেনিনস্কি প্রসপেক্ট
মেট্রো ষ্টেশনে। ওখানে ছিল কঙ্কর, তানিয়া। ভালো বইয়ের কালেকশন ছিল ওদের। প্রায়ই
আসতাম ওদের ওখানে। আর ওদের হোস্টেলের নিচে ছিল বেশ ভালো ক্যাফেটা।
ক্যাডার সেকশনে যখন এলাম, সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। ভাবলাম খুব তাড়াতাড়ি সব
করে চলে যাবো। সেখানে আরও কিছু ডকুমেন্ট যোগার করতে হোল। বিকেল ৫.৪৫ এ যখন অফিস
বন্ধ করলো, আমার তখনও কিছু ফর্ম পূরণ করতে বাকি। ভদ্রমহিলা বললেন শুক্রবার আসতে বা
কারো হাতে ডকুমেন্ট পাঠাতে।
ওখান থেকে বেড়িয়ে গেলাম ২ নম্বর ব্লকে। এই ব্লকের ৫১০ নম্বরে আমার কেটেছে
দীর্ঘ ৯ বছর ২০ থেকে ২৯। তবে এখন আর উপরের দিকে তাকাই না। ১৯৯৪ সালে দুবনা যাবার
পর পর এদিকে এলে ঐ রুমে ঢু মারতাম, দেখতাম কারা থাকে। এখন আর হয়ে ওঠে না। বলার কিই
বা আছে। এখন এখানে আসি ইন্ডিয়ান দোকানে আচার আর চানাচুর কিনতে।
ওখান থেকে বেড়িয়ে ফোন করলাম সানুকে। আজ ১০ জানুয়ারী, পাকিস্তানের কারাগার
থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাশিয়ার
উদ্যোগে দিনটা পালিত হয়, আজও হচ্ছে। যেহেতু মস্কো এসেছি, তাই ভাবলাম ঘুরে যাই যদি
কেউ আমাকে ১০ টার দিকে কোন মেট্রোতে দিয়ে আসে। রাত ১১ টার বাসে দুবনা ফিরতে হবে।
আমি সুযোগ পেলেই বাংলাদেশীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই – মূলত মানুষের সাথে দেখা
করতে। ওটাই সামনাসামনি কথা বলার একমাত্র জায়গা। দেশ নিয়ে যতই ভাবি না কেন, শুধু
ফেসবুক বা পেপার পড়ে দেশের সব খবর পাওয়া যায় না, দেশের, দেশের মানুষের নাড়িনক্ষত্র
বোঝা যায় না। মনে আছে এক সময় আমি শুধুই প্রকৃতির ছবি তুলতাম। কোথাও বেড়াতে গেলে
অপেক্ষা করতাম কখন শেষ মানুষটি চলে যাবে
আর আমি ফাঁকা জায়গার ছবি নিতে পারব। পরে মনে হয়েছে মানুষবিহীন ছবি জীবনহীন, তাই
এখন চেষ্টা করি ছবিতে মানুষও রাখতে। মানুষ আর প্রকৃতি একে অন্যের পরিপুরক। একই ভাবে
ইন্টারনেট, কাগজপত্র আর মানুষের সাথে মতবিনিময় কোন কিছু জানার জন্য একে অন্যের
পরিপুরক। কেননা একমাত্র পারস্পারিক মতবিনিময়ের মধ্য দিয়েই আমরা নিজেদের স্টেরিওটাইপ
চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি, অন্যের মত করে ভাবতে, দেখতে শিখি আর সেটা না হলেও
কোন ব্যাপারে যে ভিন্ন মত আছে সেটা বুঝতে পারি। আলো শুধু পথ দেখায় না, চোখ ধাঁধানো আলো অন্ধও
করে। আলো দিয়ে অন্ধকারকে ততক্ষণই জয় করা যায়, যতক্ষণ না আমরা অন্ধভাবে আলোর
ক্ষমতায় আস্থা রাখি। প্রশ্নহীন বিশ্বাস – এটা অন্ধত্বের আরেক রূপ। প্রশ্নহীন
বিশ্বাস – এটা বিজ্ঞানবিরোধী, এটা পেছনে চলার পথ। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখি?
আমরা নিজ নিজ জীবনে একেজন আইডল তৈরি করে নেই আর সর্বশক্তি দিয়ে তাকে পারফেক্ট
বানানোর চেষ্টা করি। ভুলে যাই ঠিক কাজ করার মত ভুল করাটাও মানুষের সহজাত। এই
সাধারণ সত্যটা না মানাটাই অন্ধত্ব, অন্ধবিশ্বাস। আর এই অন্ধবিশ্বাসও মানুষের
সহজাত। আস্তিক যেমন অন্ধভাবে ধর্মকে বিশ্বাস করে নাস্তিকের মুণ্ডুপাত করে,
নাস্তিকও তেমনি একই রকম অন্ধভাবে আস্তিকের উপর চড়াও হয়। বিজ্ঞানে বা যুক্তিতে
বিশ্বাস করলেই যে আমি মুক্তমনা তা কিন্তু নয়। আদর্শ, মতবাদ, ধর্ম, রাজনীতি এ সবই কণ্ডিশনাল,
মানে শর্ত সাপেক্ষ। এক পরিস্থিতিতে যেটা ভালো ভিন্ন পরিস্থিতিতে সেটা ভালো হবে তার
মানে নেই। তাহলে তো সমাজ বিজ্ঞানের নিয়মকানুন ফিজিক্সের ল হয়ে যেত। কথাটা এ জন্যেই
বলা যে আমরা যারা কোন না কোন আদর্শে বিশ্বাস করি, কাউকে না কাউকে আদর্শ হিসেবে
দেখে তাকে পথের দিশারী মনে করি, তাদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস শুধু সেই বিশ্বাস বা সেই
নেতৃত্বের জন্যই ক্ষতিকর নয়, শেষ বিচারে দেশ ও জাতির জন্যও ক্ষতিকর। প্রশ্ন না
করলে আমরা উত্তর খুঁজতে শিখবো না, উত্তর খুঁজতে না শিখলে পারফেকশনের দিকে এগুবো
না, শুধু এক চেনা বৃত্তের মধ্যেই আবর্তিত হব। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের উপর যেকোনো
অনুষ্ঠান নিজেদেরকে প্রশ্ন করার দিন – আমরা কী এখনো তার আদর্শেই আছি, যে বাংলাদেশ
গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এই মানুষটি নয়মাস নিজের কবরের পাশে শুয়ে দিন কাটিয়েছেন, আমরা কী
সেই স্বপ্ন নিজেদের বুকে ধারণ করি? কাউকে শ্রদ্ধা জানান, এটা শুধু তার কৃত কাজের
স্বীকৃতি দেয়া নয়, এটা তার স্বপ্নকে সামনে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে নিজেকে যুক্ত করা।
দুবনায় যখন ফিরলাম, রাত ১ টা বেজে গেছে। রাস্তায় ল্যাম্প পোষ্টের কাছে তুষারকনা
উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকির মত।
দুবনা, ১৩ জানুয়ারী ২০১৮
Comments
Post a Comment