ভয়

আমি খুব ভীতু ছোট বেলায় একটু শব্দ হলেই সাপের ভয় জেঁকে বসতো চাঁদনী রাতে একটু কিছু নড়তে দেখলে মনে হতো ভুতেরা খেলা করছে এই কিছুদিন আগেও কোথাও একদল লোক দাঁড়িয়ে আছে দেখলেই হৃদপিণ্ড সুড়সুড় করে হাঁটুর নীচে চলে যেত তবে বরাবরই আমি যতটা না ভয় পেতাম কোন লোককে, তার চেয়ে ভয় পেতাম পরিস্থিতিকে এখনো ভয়ে আমার ঘুম হয়না যদি সকালে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে আমার মনে হয় ঘুম থেকে সময় মত উঠতে পারব না, ফলে ট্রেন বা বাস মিস করবো, কাজটা হবে না তাই চেষ্টা করি কাজগুলো দিনের দ্বিতীয়ার্ধে করতে তবুও কখনো সখনো সকালে যেতে হয় যাই, ভয়ে ভয়ে
গত সেপ্টেম্বর থেকে যখন পড়াতে শুরু করলাম, শুরু হোল নতুন পরীক্ষা প্রতি সোমবার মনে হতো এই বুঝি দেরী করে ফেললাম তবে যেহেতু বাসা ছিল ইউনিভার্সিটি থেকে ২০ মিনিটের পথ, তাই ভয়ের মাত্রাটা সীমার মধ্যেই ছিল তবে ঝামেলা শুরু হোল যখন ঐ বাসা ছেঁড়ে নতুন বাসায় উঠলাম সময় বা দুরত্বের দিক থেকে অ্যাকাডেমিচেস্কায়া আর স্পোরতিভনায়া এ দুটোর জায়গার পার্থক্য নগন্য, তবে সমস্যা হোল নতুন বাসার কাজ চলছিল, তাই আমার জন্য দুবনা থেকে আসাই সঙ্গত ছিল তবে ঐ যে বললাম না এ জন্যে কাঁক ডাকা ভোরে বেরুতে হবে আর সারা রাত টেনশনে কাটাতে হবে 
দিনটা ছিল সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ সমস্যা হোল, ৭ টার ট্রেনে গেলে লেট হয় ৫ টার বাসে গেলে এক ঘণ্টা বসে থাকতে হয় আবার ৬ টায় যদি ব্লা ব্লা কার পাওয়া যায়, কোন কারণে জ্যামে পড়লে লেট হয়ে যায় ইচ্ছে ছিল ৫ টায় কোন ব্লা ব্লা কার থাকলে সেটায় করে যাওয়া হিসেবটা এমন, যদি ৭ টায় গিয়ে পৌঁছি বাসায় চলে যাবো, আর যদি জ্যামে পড়ি সোজা কাজে কিন্তু ৫ টায় কোন গাড়ী ছিল না, তাই রিস্ক নিলাম ৬ তার গাড়িতে চেপে বসলাম ঠিক ৮ টায় পৌঁছলাম মেট্রো আলতুফিয়েভা খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো বাসায় যাবো, তবে সেটা আর করা হোল না চলে গেলাম ক্লাসে ক্লাস শেষে রওনা হলাম স্মলেনস্কায়া একটা ব্যাক্তিগত কাজে অনেক দিক পর পরিচিত রাস্তা নিলাম অক্টোবরস্কায়া থেকে নিলাম ১০ নম্বর ট্রলি ১৯৯২ ড় পর এই প্রথম ভেবে অবাক হলাম, এত বছর কেটে গেছে, ট্রলির নম্বর এখনো মনে আছে আর ওরা আগের মতই চলছে কাজ শেষ ফোন করলাম মনিকাকে কথা ছিল ও তিনটের পর বাসায় থাকবে, আমি যাবো ও বলল কাজে আটকে গেছে, ফিরতে অনেক দেরি হবে আমি ওদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছিলাম কি করা? ফোন করলাম ক্রিস্টিনাকে ও বলল, আমি চাইলে ও এসে দরজা খুলে দিতে পারে কথা হোল, সেটার দরকার নেই আমি ত্রেতইয়াকভস্কায়ায় ওর সাথে দেখা করে প্যাকেটটা দেবো, তারপর চলে যাবো নিজের কাজে ফটোগ্রাফির জন্য কিছু জিনিষ কিনতে হবে মেট্রো ছোকলে জানতাম খুব হাল্কা হবে না, তবে ওগুলোর ওজন যে ৫-৬ কেজি হবে সেটা ভাবিনি বেরিয়ে আন্তনকে ফোন করলাম আমার জন্য এটা গাড়ির বুকিং দিতে,  সাড়ে ৬ টার দিকে ও দেখে বললো ৮ তার আগে কোন গাড়ী নেই কি করা? ৫.৩০ এর ট্রেন ধরা অসম্ভব দেখি যদি ৬ টার বাস পাওয়া যায় না গেলে মাঝে মধ্যে ওখানে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে ওঠা যাবে নাকের ডগা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো ৬ টার বাস দাঁড়িয়ে আছি যদি কোন ট্যাক্সি আসে দুবনার কিছুক্ষণ পরে এক ভদ্রমহিলা এলেন উনিও দুবনা যাবেন আমার মতই অল্পের জন্য বাস মিস করেছেন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি দুজনে হঠাৎ এসে দাঁড়ালো চারজন ককেসাসের ছেলে ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হাবভাবে উদ্ধত একরকম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইছিলো না, আবার চলে যে যাবো তারও অজুহাতও পাচ্ছিলাম না শেষ পর্যন্ত একটু এদিক ওদিক করে চলে গেলাম রেলওয়ে স্টেশনে আমার পরবর্তী গাড়ি মিনিমাম দেড় ঘণ্টা পরে, তাই ওখানে গিয়েই বসবো ফ্রি নেট আছে তাছাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত চলে গেলাম স্টেশনে আগেই যেতাম, আসলে স্টেশনে ঢুকতে লাগেজ চেক করে তাই আগে যাওয়া হয়নি যাহোক, বসে আছি স্টেশনে বই পড়ছি হঠাৎ দেখি সেই ছেলেগুলো হাজির জানি, এখানে পুলিশ আছে, ওরাও মেটাল ডিটেকটর পেরিয়ে এসেছে, তার পরেও কেমন একটা ভয়ে পেয়ে বসলো আমায় বই পড়ার ভাব করলাম ঠিকই, তবে পড়া হোল না মনে পড়লো নব্বইয়ের দশকের কথা
১৯৯৫ আমি দুবনায় কাজ করি এক বছর হোল মনিকার বয়েস তখনও এক বছর হয়নি ওরা থাকতো মস্কো, আমি শুক্রবার দুবনা থেকে মস্কো ফিরি, সোমবার চলে যাই মুদ্রাস্ফীতি তখন তুঙ্গে সকালে যে টাকায় যে পরিমান জিনিষ পাওয়া যায়, বিকেলে সেটা পাওয়া যায় না যে বেতন পাই, তাতে মনিকা, আন্তনের চাহিদা মিটলেও আমাদের চলে একাদশী করে কাকু তখন মস্কোয় আমি মস্কো গেলেই বেড়াতে আসেন তারও সময় কাটে না জুলাইয়ের এক রবিবার কাকু এলেন না ভাবলাম আমিই গিয়ে দেখা করবো অল্প কিছু টাকা ছিল, নিয়ে গেলাম ফেরার পথে বাচ্চাদের জন্য ফল কিনব বলে আমরা তখন থাকি লেনিনস্কি প্রোসপেক্টের বাসায় হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম মেট্রো ইউনিভার্সিটি ওখান থেকে মেট্রো না নিয়ে উঠে বসলাম ৩৪ নম্বর ট্রলিতে ইউগো-জাপাদনায়ার কাছে এসে নেমে পড়লাম যাতে পেছন দিকে হাঁটতে না হয় একটা স্টপেজ যাবো বাসে, তারপর বাস চেঞ্জ করে কাকুর বাসায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্ট হোল, এক লোক গাড়ির নিচে পড়লো, যদিও বেঁচে গেলো শেষ পর্যন্ত তখনই খেয়াল করলাম আমার পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন ককেসাসের ছেলেকে আমি বাসে উঠলাম, ওরাও উঠলো এক স্টপেজ গিয়ে আমার পেছন পেছন ওরাও নেমে পড়লো ওখান থেকে আমি অন্য বাস নিলাম ওরা উঠলো পেছনের গেটে দু স্টপেজ পর আমি নেমে দেখি ওরা দাঁড়িয়ে আছে এরপর হাঁটা পথ মাঝে আমি দুবার দুটো দোকানে ঢুকলাম ওরাও ঢুকে কি যেন দেখল তারপর এক সময় আমি ওদের হারিয়ে ফেললাম কাকুর বাসার সামনে এসে ভাবলাম, বা রে, এতটা পথ একসাথে আসলাম, আর এখন ওদের পাত্তা নেই মনে হোল, পাশেই যে ক্যাফে হয়েছে, নিশ্চয়ই সেখানে গেছে খেতে কাকুর যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির গেটে ঢুকে লিফটের ওখানে দেখি ওরা দাঁড়িয়ে আছে মনে মনে একটু খুশিই হলাম যদিও প্রকাশ করলাম না দুদিন আগেই টিভিতে  অপরিচিত লোকদের সাথে লিফটে না উঠতে বলেছে, উঠলেও  সবার পরে লিফট এলো ওদের একজন ঢুকে পড়লো, অন্যেরা আমাকে ঢুকতে বলল আমি কিছু সন্দেহ না করেই ঢুকে পড়লাম এরপর ওরা আমি কিছু বলার আগেই একদম শেষের তলায় টিপ দিয়ে বলল টাকাপয়সা যা আছে দিতে আমি এতটাই অবাক হয়ে গেছি যে কথা বলতে পারছিলাম না হাত কাঁপছিল বললাম, পকেট চেক করে ওরাই যেন নিয়ে নেয় চোখের সামনে ভেসে উঠলো মনিকার মুখ ওরা একদম উপরের তলায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে লিফট নিয়ে চলে গেলো সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি ওখানে তালা যদিও ভয় লাগছিলো আবার লিফটে উঠতে, কোন উপায় ছিল না অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর লিফট এলো নেমে এলাম কাকুর বাসায় সব বললাম কাকু কিছু টাকা ধার দিলেন মনিকার জন্য ফল আর আমার দুবনা যাবার ভাড়া বাবদ
আমি জানতাম, এখন নব্বইয়ের দশক নয় এরা আমার টাকা নেবে না তবে ওদের আচরণে ভয় লাগলো অন্য কারণে ওদের একজন আমার পাশে বসে যেন নিজে নিজেই বলল “আবু বকর আল বাগদাদি“ ভাব করলাম, যেন এ নামটা আমাকে কিছুই বলে না, যদিও যত দুর জানি ও ইসলামিক স্টেটের প্রধান ছিল  আচ্ছা এরা যদি টেরোরিষ্ট হয়? যদি স্টেশন উড়িয়ে দেয়? এখানে অনেক পাহারা এমনি এমনি কেউ ঢুকতে পারে না সন্দেহজনক কিছু দেখলে নিশ্চয়ই আটকাতো এসব ভাবতে ভাবতে যেন শিগগীরই আমার ট্রেন এ ভাব করে উঠে দাঁড়ালাম এর মধ্যেই আমি ৮ টায় ব্লা ব্লা কার বুক করেছি ছাড়বে আলতুফিয়েভা থেকে এখান থেকে যেতে মিনিট কুড়ি বাইরে বেশ ঠাণ্ডা বরফ পড়ছিল আমি এসে পৌঁছুলাম একটু আগেই ড্রাইভারকে ফোন করলে বলল ওর একটু দেরী হবে আমার ফটোগ্রাফির জিনিষপত্র নিয়ে ম্যাকডোনালডে বসতে ইচ্ছে করছিলো না, আবার বাইরেও বরফ পড়ছিল অনবরত একবার ভেতরে ঢুকি আবার বাইরে যাই – এভাবে কাটল মিনিট কুড়ি শেষ পর্যন্ত আর্তম এলো চললাম আমরা দুবনার পথে যাচ্ছি আর ভাবছি, এই যে আমি একদল অচেনা লোককে সন্ত্রাসবাদী বলে সন্দেহ করলাম, কাজটা কি ঠিক হোল? আমার বিশ্বাস ওদের যদি দাঁড়ি না থাকতো  আমি হয়তো এমনটা ভাবতাম না আমাদের যৌবনে আমরাও তো কয়েকজন এক সাথে হলে এমনটাই করতাম, একটু বাঁদরামি, একটু দুষ্টুমি বর্তমান যুগ আমাদের যেমন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কিনতে শিখিয়েছে, ঠিক তেমনি করেই অন্যদেরকে কারণে অকারণে সন্দেহ করতে শিখিয়েছে ভয়টা যেন কফিন হয়ে আমাদের সবাইকে ঢেকে  রেখেছে ভালো আছি কী আমরা ভয়ের লেপ মুড়ি দিয়ে?  

দুবনা, ১৭ জানুয়ারী ২০১৮ 


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি