কষ্ট
একদা এক দেশে এক চেয়ার ছিল। একা একা সে
বেশ ছিল। যদিও কোন দিন এই দেশে কোন সিংহ ছিল না কিংবা কোন সিংহের পশ্চাৎদেশ
তাহাকে চুম্বন করে নাই, তবুও দেশের মানুষেরা তাহাকে সিংহাসনের মত সম্মান করিত এবং সবাই
সুযোগ খুঁজিত নিজের পশ্চাৎদেশ তাঁহার উপর স্থাপন করিবার জন্য। এই লইয়া দেশের
মানুষের বিশেষ করিয়া যাহারা কেহ শিক্ষায়, কেহ দীক্ষায়, কেহ বিত্তে, কেহবা পেশীবলে নিজেদেরকে
বড় বলিয়া মনে করিতেন তাহাদের মধ্যে কলহের অন্তঃ ছিল না। ইহা প্রকাশ
পাইত পারিবারিক ফটোসেশনের সময়। চেয়ার নিজের উপর সব মানুষের কটাক্ষ
দৃষ্টি অনুভব করিত এবং শেষমেশ বেকার বসিয়া থাকিত। ইহা লইয়া
তাঁহার দুঃখের সীমা ছিল না। সে তখন বাবার আমলের কথা মনে করিত। তাঁহার বাবা
বলিত
আগে লোকেরা বনেদী ছিল। চেয়ারের কদর
জানিত। যোগ্য লোককে চেয়ারে বসাইত। বসিত বাড়ির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি,
অথবা মহিলা। অনেক সময় শিশুরাও বসিত। চেয়ারে যে
বসিত সে ছিল সবার ভালোবাসার পাত্র। ফলে তাহাকে আর আমাকে ঘিরিয়া তাহাদের
ভালোবাসার প্রকাশ পাইত। আমি ছিলাম সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সবার ভালোবাসার ধন। যদি পাশের
বাড়ি হইতে কেউ বেড়াইতে আসিত তবে ভদ্রতা করিয়া তাহাকেই সবার আগে চেয়ারে বসানো হইত।
এখন আর সেই সময় নাই। নব্য ধনী
আর নব্য জ্ঞানী মানুষেরা হুটহাট ধন বা ডিগ্রী লাভ করিলেও বনেদী হইতে পারে নাই। তাই তাহারা
নিজেদের নম্রতা, ভদ্রতায়, শিক্ষাদীক্ষায় মহত্ব না দেখিয়া চেয়ারে মহত্ব দেখে। কে কি বলিল
সেটা নয়, কে কাহার আগে বা পরে বক্তৃতা দিল, তাঁহার উপর ভিত্তি করিয়া নিজেদের গুরুত্ব
নির্ধারণ করে। পারস্পারিক ভালোবাসা বস্তুটি আজকাল দুষ্প্রাপ্য।
একবার পাশের দেশে হইতে এক গণ্যমান্য
ভদ্রলোক বেড়াইতে আসিলেন। নিজেদের মধ্যে কাহার চেয়ারে বসা উচিৎ ঠিক করিতে না পারিয়া
অতিথিকে সবাই চেয়ারে বসাইয়া ছবি তুলিলেন। ছবি দেখিয়া মনে হইল
ইহাতে কেউই মনঃক্ষুণ্ণ হন নাই। কিন্তু মনঃক্ষুণ্ণ হইল বাড়ির সেই মানুষেরা
যাহারা কখনো সেই চেয়ারে বসিবার সুযোগ পান না। তাহারা চুলচেরা
বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইতে লাগিল ইহাতে দেশের মান কোথায় কত ছটাক কমিয়া গিয়াছে। আর এইসব বিশ্লেষণের
ফলে অতিথিকে দেখানো সমস্ত ভদ্রতা এক মহা অভদ্রতায় পরিণত হইল। তাহাদের হীনমন্যতায়
দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের দৈন্যতা প্রকটভাবে প্রকাশ পাইল। খবরের কাগজে,
টিভিতে আর সামাজিক মাধ্যমে এসব খবর দেখিয়া চেয়ার অতি মনঃক্ষুণ্ণ হইল। সে তাঁহার
বাবার কথা ভাবিল আর অসময়ে জন্ম লইবার জন্য নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করিতে লাগিল।
দুবনা, ২১ জানুয়ারী ২০১৮
Comments
Post a Comment