সরস্বতী পুজো

 ৯০ এর দশকের প্রথম দিকের কথা। কাকুর সাথে তখন বেশ বন্ধুত্ব। সময় পেলেই চলে যাই কাকুর বাসায়, খেতে আর গল্প করতে। গল্প হয় বিভিন্ন বিষয়ে – রাজনীতি, সাহিত্য – বিষয়ের কোন শেষ নেই। কোন কারণে বেশ কয়েকদিন ওদিকে না গেলে হঠাৎ করে কাকু নিজেই চলে আসতেন আর হেসে হেসে উচ্চস্বরে বলতেন
- পালাবে কোথায়?
তখন না ছিল ইন্টারনেট, না ছিল মোবাইল ফোন। আজকের এই ইন্টারনেট আর মোবাইল
ফোনের যুগে পালানো সত্যিই অসম্ভব। বন্ধুরা না বের করলেও ফেসবুক ঠিকই জানিয়ে দেবে
আজ থেকে কত বছর আগে এই দিনে তুমি কোথায় ছিলে, কার সাথে কি ছবি তুলেছিলে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথবা আজ কার জন্মদিবস বা মৃত্যুদিন। ইদানিং কিছু বন্ধু অবশ্য এক কাঠি সরস,
শুধু তোমাকে প্রাণপ্রিয় বন্ধু বলেই ডাকবে না, জানিয়ে দেবে তুমি যেন যাদের তেমন মনে কর
তাদের কাছেও খবরটা পাঠাও, এমন কি তাকেও যদি পাঠাও তাতেও কোন আপত্তি নেই।
অনেকটা সেই স্কুল জীবনে সন্তোষী মার চিঠির মত, যদি এই সংখ্যক লোককে চিঠি না
পাঠাও কপালে কষ্ট আছে। আমি অবশ্য ক্যাটাগরিক্যালি এসব চিঠির উত্তর দেই না, যদিও
সব ব্যক্তিগত চিঠির উত্তর দেয়া আমার জীবন দর্শনের একটা অংশ। আর এই চিঠির উত্তর
না দেবার কারন, আমি ম্যানিপুলেশন পছন্দ করি না।
যাকগে যে কথা বলছিলাম, অনেক কিছু নিয়ে মাথা না ঘামালেও ফেসবুকের বদৌলতে
অনেক খবরই চলে আসে। গতকালও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে
দেখি ইনবক্স সরস্বতী পুজোর শুভেচ্ছায় ওভারলোডেড। পুজোর কথাটা জানতাম। দিদিসহ
অনেকেই বলেছে। তবে যেসব কাজে আমি অংশগ্রহন করি না সেসব খবর দিয়ে করোটির সেলফগুলো অযথা ভরে রাখার অর্থ বুঝি না। তাই চুপচাপ সেসব কোন মেমোরি ষ্টিকারে
ঢুকিয়ে দিই। তাছাড়া গতকাল সারাদিন পরীক্ষানেয়াসহ বিভিন্ন কাজে মস্কো ছিলাম বলে
কাউকে উত্তর দেয়া হয়নি, যদিও সকাল থেকে শুভেচ্ছা পেয়ে পেয়ে নিজের অজান্তেই
চলে গেছি শৈশব আর কৈশোরের সেই দিনগুলোতে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কড়চার কথা।
এটা অনেকটা আখের মত, তবে আগাছা। ওটা দিয়ে আমরা কলম তৈরি করতাম। যদি ভুল
না করি, ওর পোশাকি নাম মনে হয় নলখাগড়া। মনে পড়লো সাদা কালির কথা। হয়তো দুধ
আর ময়দা দিয়ে তৈরি। অখিল ঠাকুর তৈরি করতো এসব। অনেকক্ষণ ধরে মনে করলাম
কোথায় লিখতাম এই কলম দিয়ে। হাতড়ে হাতড়ে পেয়ে গেলাম বেল পাতার সন্ধান।
আমাদের গুদামের পাশেই ছিল বেল গাছ, যেখান থেকে পাতা পাড়া হতো। কী অসম্ভব
সুস্বাদু ছিল ওর বেল। আমার খুব প্রিয়। দেশ ছাড়ার পর হাতে গনা দু একটা ফলের একটা
এই বেল – যার আর দেখা মেলেনি। শহীদ মিনার যেমন বর্ণমালা দিয়ে সাজাই, ঠিক
সেভাবেই বিল্বপত্রে বর্ণমালা লিখে অঞ্জলি দিতাম মা স্বরস্বতীর পায়ে আর অখিল ঠাকুরের
সাথে সুর করে বলতাম
জয় জয় দেবী, চড় চড় স্বরে ......
এসব মনে করতে করতে মনে পড়ে গেল পাড়ার বন্ধুদের কথা। আমাদের পাশের বাড়িতে
থাকতো সাধন, ভজন আর ভগীরথ সাহারা। ওরা আমার বাবাকে কাকা বলে ডাকতো। সাধন
সাহার ছেলেরা ছিল আমার খেলার সাথী, কেউ কেউ বা ক্লাসমেট। আমি ছিলাম বাড়ির ছোট।
সাত ভাই আর এক বোনের সংসারে সবার ছোট। ছোট বেলায় ভাইবোনদের সংখ্যা নিয়ে খুব
গর্ব হতো। পাড়ায় আর কোন বাড়ি এতো ভাইবোন ছিল না। তবে পাগলা, সন্তোষ, মনা, পানা
মানে পরিতোষ, সন্তোষ, মনতোষ, প্রানতোষরা দ্রুত সংখ্যায় বাড়ছিলো। কী মন খারাপই না
হয়েছিল আমার যখন ওরা সংখ্যায় আমাদের ছাড়িয়ে গেলো। । যাই হোক, আমি তখনও স্কুলে
যেতে শুরু করিনি। সেই সময় ভজন ভাস্তের লক্ষ্মী নামে এক মেয়ে জন্ম নেয়। আসলে এ
বেনামেই ভূমিষ্ঠ হয়। পরে ওর বাবা মা ওর নাম রাখে লক্ষ্মী। সম্পর্কে যেহেতু নাত্নী, আমাকে
সবাই ঠাট্টা করতে শুরু করে ওকে নিয়ে। তবে না সেই লক্ষ্মীর সাথে না মা লক্ষ্মীর সাথে –
কারো সাথেই আমার কখনই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। সেদিক থেকে আমি বরাবরই লক্ষ্মীছাড়া।
যখন কেবল মাত্র লিখতে শিখলাম একদিন বড়দার কাছারি ঘরের দরজায় চক দিয়ে লিখলাম
“মনা শীল, পানা শীল।“ শীল মানে নাপিত। এটা আমরা কাউকে ছোট করার জন্য বলতাম।
র‍্যাসিস্ট ছিলাম মনে হয়। তবে নিজের অজ্ঞতার কারণেই হোক আর কেউ ঠাট্টা করেই করুক,
পরের দিন দেখা গেল ওখানে লেখা “মনা শীল, পানা শালা।“ আর যাবে কোথায়? সবাইতো মহা
উল্লাসে লাগলো আমার পেছনে। ঐ সময় ওদের মা ছিল সন্তান সম্ভবা। সবাই বলতে শুরু
করল, এবার যদি ওদের বোন হয়, তোকে সেই মেয়ে বিয়ে করতেই হবে। আর কপাল
এমনই খারাপ যে, ওদের এবার বোন হল যার নাম রাখল সরস্বতী। মনে পড়ে, সেই সময়
সবার সাথে আমিও যদি “সরস্বতী মা কী জয়” বলতাম, চারিদিক থেকে বন্ধুরা টিটকিরি শুরু
করতো। এর ফলে দাঁড়ালো আমরা সারা জীবনই একে অন্যের সাথে কথাবার্তা বলতে আড়ষ্ট
বোধ করতাম। জানি না মনাপানারা বা লক্ষ্মী-সরস্বতীরা এখন কে কোথায় আছে, কিন্তু
কল্পনায় ফেলে আসা সেই দিনগুলোয় ফিরে গিয়ে ভালই লাগলো।
কেন যেন মনে হয় সরস্বতী পুজোর আমার আগ্রহ একটু বেশি ছিল। প্রথমত এ পুজোটা শুধু
যে বাড়িতেই হতো তা নয়, ক্লাবে আর স্কুলে হতো। আর যেহেতু বাচ্চারা আর ছাত্রছাত্রীরাই
ছিল এ পুজোর স্বত্বাধিকারী সে কারণেও আগ্রহটা ছিল বেশি। আর যে কারণ ছিল, সেটা খুব প্র্যাকটিক্যাল। এর আগ পর্যন্ত বরই বা কুল ছিল নিষিদ্ধ। বলা হতো পুজোর আগে কুল খেলে
পরীক্ষায় শুন্য অবধারিত। আমি অবশ্য এসবের ধার যে খুব একটা ধারতাম, তা নয়। তাছাড়া
আমার জন্য বাবার সমর্থন ছিল নিঃশর্ত। বাবা বলতেন, পুজোর আগে কুল কাঁচা থাকে, তা
খেলে কাশি হয়। তাই এই নিয়ম। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কুল খেলে যাতে পরীক্ষা নিয়ে
টেনশনে না ভুগি বাবা হয়তো সেটাই করতেন। তবে পুজো শেষ হলে আমাদের আর
পায় কে? মুহূর্তের মধ্যে পাড়ার কুলগুলোর মৃত্যুদণ্ড জারি হয়ে যেতো। কল্যাণদার ভাষায় “
আজ কুল ভক্ষন দিবসের শুভারম্ভে সবাইকে জানাই সংগ্রামী ও আন্তরিক অভিনন্দন!
ভালোই ছিল বেচারীগুলো,সরস্বতী পূজো এলো কুল প্রজাতির নিধনের পরোয়ানা নিয়ে!
বেচারা কুলগুলো এখন অকুল দরিয়ায়। যারা মা সরস্বতীর রোষ থেকে বাচার জন্য, কুলকে
এড়িয়ে যেত, তারাও আজ থেকে নির্ভয়ে কুল খাবে, ফেল করার কথা মাথা থেকে
গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে।”
শেষ সরস্বতী পুজো দেখা হয় ২০১২ দেশে বেড়াতে গিয়ে। তবে ফেসবুকে এখন সরস্বতীর
রূপ অনেকটা মডেল কন্যা মডেল কন্যা মত। এমন কি তার পড়নে রঙ বেরঙের পোষাকও।
আমাদের সময় দেবী ছিলেন শান্ত, শ্বেতবর্ণা। গোলাপি পদ্ম আর সাদা রাজহাঁসের সাথে যাকে
দেখলে মনে হত সত্যিকারের জ্ঞানের প্রতীক। আমি অবশ্য জানি না, জ্ঞানের বর্ণ শুভ্র কিনা।
তবে জানার মুল কথা অজানাকে স্বীকার করা, “আমি জানি না” এ কথা নির্দ্বিধায় বলা। জানি
না বলেই তো জানার স্পৃহা। তাই সাদা যদি অজানার প্রতীক হয়, তা একই সাথে জ্ঞানের
প্রতীকও হতে পারে। আবার এটাও হতে পারে, তখন বয়েস কম ছিল, তাই সাদার প্রতি,
শুভ্রতার প্রতি এক সহজাত শ্রদ্ধা ছিল। আজকাল তো আমরা জ্ঞান চাই না, চাই ডিগ্রী।
আর ডিগ্রী দেবার জন্য আধুনিক সাজে সজ্জিতা সরস্বতী অনেক যুগোপযোগী।
লক্ষ্মী সরস্বতীর মধ্যে আমার কেন যেন মনে হয় মা লক্ষ্মী অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমায় ঠিক মত নারুমুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করলে উনি খুব খুশি হন
আর এমন কি অলসকেও অঢেল হস্তে ধনদৌলত দান করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু মা
সরস্বতী অনেকটা পশ্চিমাদের মত। যারা নিজেদের সাহায্য করে উনি শুধু তাদের পাশেই
দাঁড়ান। আর তাইতো কষ্ট না করে ডিগ্রী লাভ করা গেলেও সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনের জন্য
অনেক খরকুটো পুড়াতে হয়। পুঁজিবাদকে বাইপাস করে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হলেও
লেখাপড়া বাইপাস করে জ্ঞ্যানার্জন অসম্ভব।
সবাইকে সরস্বতী পুজোর শুভেচ্ছা।
দুবনা, ২৩ জানুয়ারী ২০১৮

                                 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি