স্বল্প আলোয় ঝাপসা ছবি
বাইরে শিশু সূর্যের ঝলমলে হাসি, নীচে
দিগন্ত বিস্তৃত লাল-হলুদের ঢেউয়ের সাগরে এখানে সেখানে সবুজের ছোঁয়া, সামনে অজানা অচেনা
দেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর বুকের ভেতর অজেনাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অজেয়কে জয় করার
প্রবল ইচ্ছা। কিছু জামাকাপড় আর বই বাদ দিলে এই ছিল মস্কো শেরমিতোভা বিমানবন্দরে
অবতরণের পূর্বে আমার সম্বল। আর ছিল কিছু কয়েন, বাংলাদেশী কয়েন,
নো ডলার, নো পাউন্ড – নাথিং। দেশ থেকেই অনেক কমরেড বলেছিলেন, ডলার-
পাউন্ড থাকলেই সেগুলো চোরাবাজারে ভাঙ্গানোর ইচ্ছে জাগে। আপেল খেয়ে
যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িতই হতে হয়, বেটার আপেল গাছটাই কেটে ফেলা। সেটা অবশ্য
সেই সময়ের কথা। এখন কোন কিছুর প্রতি আসক্তি দেখা দিলে সেটা বরং আমি কিনে
ঘরে রেখে দেই আর কোন অবস্থাতেই সেটা ব্যবহার করি না। নিজের লোভকে
সংযত করি আর কী। বাইরে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুহূর্তেই ভুলে গেলাম দেশত্যাগের
ব্যথা, নতুনকে দেখার, নতুনকে জানার জন্য খুলে গেলো মনের দরজা।
রাত কেটেছে কেমন এক ঘোরের ভেতর। যদিও বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই), করাচী
আর তাসখন্দের যাত্রা বিরতি চিন্তার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে, তবে সেটা ছিলো ক্ষণস্থায়ী। এসবের মধ্যেই
বারবার ভেসে উঠেছে বাবা-মা, ভাইবোনদের মুখ। আমাদের মস্কো আসার
কথা ছিল ২২ আগস্ট, পরে ২৯ আগস্ট ডেট ঠিক হয়,
কিন্তু টিকেট সংক্রান্ত ঝামেলায় আমরা ফ্লাই করি ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ – রওনা হই স্বপ্নের
দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে। এ দেশের প্রেমে পড়ি অনেক আগে, দস্তয়েভস্কি আর চেখভের বই পড়ে
সেই স্কুল জীবনে। রাজনীতি না করলেও রাজনীতির খবর রাখতাম, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের
উপর এক-আধটু পড়াশুনাও করতাম। তবে কলেজ জীবনে যখন ছাত্র ইউনিয়নে
যোগ দেই আর পরীক্ষা শেষে যখন উদীচী, খেলাঘর এসব নিয়ে মেতে উঠি, এমন কি সিপিবির সিএম হই, বাবা বলে দেন আমার আর দেশে থাকা চলবে না। চাইলে ইন্ডিয়া
গিয়ে আই আই টি তে পড়তে পারি, অথবা আমেরিকা যেতে পারি – বাবা টাকা দেবেন, অথবা যে রাজনীতি
করি সেই সোভিয়েত দেশে যেতে পারি। যেতে হবেই। আমার স্বপনদা,
যে আমার ছয় মাস বয়সে দেশ ছেঁড়ে চলে যায়, আর জি কর মেডিক্যালে পড়ার সময় নক্সালে যোগ
দিয়ে আলীগর জেল ভেঙ্গে তখন পলাতক। বাড়ি থেকে আরও একজন রাজনীতি করে ক্যারিয়ার
নষ্ট করুক, বাবা সেটা চান নাই। তার কথা, আগে পড়াশুনা শেষ কর, নিজের
পায়ে দাঁড়াও, তারপর রাজনীতি কর, কোন আপত্তি নেই, কিন্তু এখন সেটা চলবে না। তাই আমার
সোভিয়েত দেশে আসা। কারণ আরও একটা ছিল। আমি বরাবরই
পদার্থবিদ্যায় পড়বো বলে ভেবেছি। আমাদের রেজাল্ট দেবার পর প্রথমে পরীক্ষা
হোল বুয়েটে, ওখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেলাম। কী করবো ভাবছি,
বুয়েটের নিমাইদা, দেবুদা এরা বললেন ঢাকা ভার্সিটিতে সেশন যট, তাই যেন এখানেই ভর্তি
হই। এরই মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল আহসানউল্লাহ হলের অনেকের সাথেই, রয়ে গেলাম। ক্লাস শুরু
হোল আগস্টের প্রথমে। ফিজিক্সের ক্লাসে টিচারকে কি একটা জিজ্ঞেস করায় বললেন, ইঞ্জিনিয়ার
হবার জন্য এসব না জানলেও চলবে। তখনই ঠিক করলাম, এখানে আর নয়, মস্কো
না হলে পরের বছর ঢাকা ভার্সিটিতে ফিজিক্সে ভর্তি হব। তাই যখন খবর
এলো প্যাত্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ হয়ে গেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ, তখনই
বাড়িতে বললাম, আমি যাচ্ছি ফিজিক্স পড়ার জন্য, ওখানে গিয়ে কিন্তু সাবজেক্ট চেঞ্জ করবো।
যখন মস্কো আসা ঠিক হয়ে গেলো বুয়েটে ক্লাস বাদ দিয়ে চলে গেলাম বাড়ি। আসলে আমি
ববাবর বাড়িতেই থাকতাম। গ্রমের স্কুলেই পড়াশুনা, তারপর মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ। আমার যখন
জন্ম, বাবার বয়েস ৫৬। তাই আমাকে কখনই একা একা কোথাও যেতে দিতেন না। ফলে বুয়েটে
ক্লাস করার সময়ও আমি প্রায়ই বাড়ি চলে যেতাম, সকালে বাড়ি থেকে এসেই ক্লাস করতাম। তখন মানিকগঞ্জ
থেকে বুয়েটের মোড় পর্যন্ত আসতে লাগলো ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। শেষের ক দিন
বাড়িতে কাটালাম বই পড়ে আর ছোট বেলার গল্প করে। “ভাই, তোর মনে আছে ঐ ঘটনাটা?” জিজ্ঞেস
করতো দিদি। কেমন এক বিষাদের ছায়া সবার মধ্যে, ঠিক যেমনটা দেখা যায় মেয়ে
বিয়ে দেবার আগে। বাড়ি থেকে বিদায়
নিয়ে ঢাকা এলাম রতনের সাথে। ও আমার ইমিডিয়েট বড়। ও ই নিয়ে
এলো এয়ারপোর্টে। কথা বলছি আর বলছি – কথার শেষ নেই, খেলাঘরে কি করতে হবে, কে
কি করবে কত কী। তারপর এক সময় ঢুকে গেলাম লাউঞ্জে। কিছুক্ষন
পরে দেখি রতন দাঁড়িয়ে জানালার ওদিকটায়, আমাকে খুঁজছে। আমি এগিয়ে
গেলাম, দুজনেই বলার চেষ্টা করলাম আর এক সময় বুঝলাম আমরা একে অন্যকে শুনতে পাচ্ছি না,
কাস্টমস পার হবার পর আমরা যেন দুই জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছি। গলার কাছে
কিসের একটা দলা অনুভব করলাম। সরে এলাম জানালার কাছ থেকে। পরে কাগজ
বের করে লিখে লিখে কথা বলতে লাগলাম। ঢাকা এয়ারপোর্টেই শুরু হোল নতুন জীবন,
চিঠি লিখে মত বিনিময়ের জীবন!
এরোফ্লতের বিমানে মস্কোর পথে আমার সাথী ছিল ইকবাল, এছাড়া ছিল আরও নয় জন যাদের
আমি দেশে থাকতেই চিনতাম। সেবার আমরা দশ এসেছিলাম রাশিয়ায় সিপিবির স্কলারশিপ নিয়ে। আমি বাদে
ছিল জালাল, আনোয়ার, শুভ, মফিজ। আমরা সবাই প্যাত্রিসে যাচ্ছি। আর ছিল আরিফ,
আজাদ, কল্লোল – ওরা মস্কোর মাদীতে থেকে যায়। জয়নাল ক্রাস্নাদারে
আর (যতদূর মনে পড়ে) দীপঙ্কর রোস্তভে। আমার পথের সাথী ইকবালও চলে যায় রোস্তভে। ও এসেছিলো
ছাত্র ইউনিয়নের স্কলারশিপে। আমরা যারা প্যাত্রিসে এসেছিলাম, দেশ
থেকে জানতাম আমাদের গন্তব্য – বাকীরা সময় কাটিয়েছে দুশ্চিন্তার মধ্যে – কে জানে কোন
দুর শহরে সে যাবে, আছে কি সেখানে কোন বঙ্গ সন্তান?
সব চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটিয়ে এরোফ্লতের বিমানটি শেষ পর্যন্ত নামলো মস্কো বিমানবন্দরে। গ্রাম বাংলায় বড় হলেও সাহেবরা আমার কাছে অপরিচিত ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের
আগেই আমেরিকার ভ্যানেল কোম্পানি তরা ব্রীজ নির্মাণ শুরু করে, সেই সুত্র ধরে আমাদের
গ্রামে শুরু হয় সাহেবদের আনাগোনা। যুদ্ধের পরে মেমরাও আসে যুদ্ধ আর লুটের
কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত গ্রামবাসীদের জন্য সাহায্য নিয়ে। তবে ওরা ছিল
সংখ্যালঘু, আমাদের মাঝখানে ওদের মনে হতো বিশাল কালো ক্যানভাসে দুয়েকটা সাদা আঁচড়ের
মত। মস্কো এয়ারপোর্টে নেমে অসংখ্য সাদা মানুষের ভিড়ে আমরা হয়ে গেলাম সংখ্যালঘু,
এই প্রথম এতো সাহেব আর মেমদের দেখলাম একসাথে। ওই ভিড়ের
ভেতরই প্রথম দেখলাম এক শিশুকে, দুধের মত সাদা আর নাদুস-নুদুস শিশু। কেন যেন মনে
হোল, পড়াশুনা শেষ করে যখন দেশে যাবো, এমন একটা শিশু চুরি করে নিয়ে যাবো। চুরি করা
ছাড়াও যে মানব শিশু পাওয়া যায় সেটা তখন মনেই হয়নি। আমার আর কাউকে
চুরি করতে হয়নি, আমার শিশুরাই বরং ভালোবাসার জালে আমাকে আটকে রেখেছে এই রুশ দেশে।
বিমান থেকে নেমে যখন কাস্টমসের ঝামেলা মিটিয়ে বেরুলাম, মস্কোর বড় ভাইরা আমাদের
জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মনে পড়ে মলয় দার কথা, উনি তখন গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের
বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের সভাপতি। মনে হয় রফিক ভাইও এসেছিলেন আমাদের
নিতে। উনি ছিলেন অল সোভিয়েতের সভাপতি। কে যেন আলাপ করিয়ে দিল মাহমুদ ভাইয়ের
সাথে এই বলে যে উনি অল সোভিয়েতের পরবর্তী সভাপতি। মলয় দার সাথে
পরিচয় করিয়ে দিতেই তাকে বললাম আমার সাবজেক্ট চেঞ্জের কথা। মনে হয় আমার
এই উদ্ভট প্রস্তাবে শুধু মলয় দা নয়, সবাই অবাক হয়েছিলেন। সাধারণত সবাই
ফিজিক্স থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিসিনে চেঞ্জ করে, আর আমি কিনা উলটো পথে হাঁটছি! এয়ারপোর্টে
আমার চোখ খুঁজছিল দুজন লোককে – একজন সালাম ভাই, মানিকগঞ্জের ছেলে, অন্যজন মিন্টুদা
(সুপ্রভাত রায়), আমার বুয়েটের রুমমেট দেবুদার ভাই।
কিন্তু ক্লাস থাকার কারণে ওরা আসতে পারেনি। কে যেন বললো,
চিন্তা করো না, ওরা দুজনেই প্যাত্রিসে পড়ে, বিকেলে দেখা করবে। সবাইকে নিয়ে
বাস চললো মস্কোর পথে। মলয়দা জিজ্ঞেস করলেন কে কে আমরা গাইতে পারি। তখন থেকে
অনেক দিনের জন্য আমি হয়ে গেলাম আমাদের কোরাসের সদস্য। শুভ বলল ছবি
আঁকার কথা। আমি টুকটাক ছবি আঁকতাম, তাই শুভর সাথে সাথে আমিও সায় দিলাম। তবে আমার
আর ছবি আঁকা হয়ে উঠলো না, আঁকার পরিবর্তে ছবি তোলাতেই মেতে উঠলাম আমি। প্রথম সাতদিন
আমাদের কাটলো কারেন্তেইনে যত্তসব অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে। তাই একদিন
যখন বড়ভাইরা চোরাপথে আমাদের নিয়ে গেলো ভাত খাওয়াবে বলে আমাদের আনন্দ দেখে কে? এই প্রথম
অনুভব করলাম ভাত আমার কত প্রিয়। খাবার ব্যবস্থা হোল ১ নম্বর ব্লকের
৫১৭ নম্বর রুমে, মিন্টু দা আর শিশির দার ঘরে। জীবনে এর
আগে বা পরে কখনো এতো ভাত খাইনি। নিজেই অবাক হয়ে গেছি নিজের খাওয়া দেখে। খাবার শেষ
বসে আছি, মিন্টু দা বললেন প্লেটটা ধুয়ে ফেলতে কিচেনে গিয়ে। আমি যেন আকাশ
থেকে পড়লাম। মনে হোল, আগে যদি জানতাম, খেতামই না। তবে মুখে
কিছু না বলে ঠিকই প্লেট ধুয়ে আনলাম। জীবনে অনেক কিছুই নতুন করে শিখতে হয়,
এটাও ছিল সেরকম এক শিক্ষা। তখন নতুন করে অনুভব করলাম আমি আর দেশে
নেই, এখানে নিজে নিজেই সব কিছু করতে হবে, নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে। আর সেটা বিশেষ
ভাবে বুঝলাম ভাষা ক্লাসে গিয়ে। মনে পড়লো ছোটবেলার কথা, যখন এমনি করেই
অ-আ-ক-খ শিখতাম, এমনি করেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে শব্দ উচ্চারণ করতাম। নতুন দেশে
নতুন পরিবেশে সবাই যেন শিশু বনে গেলাম।
আজ এতো বছর পরে যখন পিছন পানে তাকাই, কত কথাই না মনে পড়ে! আচ্ছা কোন ঘটনাগুলো
আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে? আমার তো মনে হয় সে সময়ের আমার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি পদক্ষেপ
আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। সবার ক্ষেত্রেই এমনটি হয় যদি সে থাকে
লক্ষ্যে স্থির। আজ এতদিন পর তাহলে কী নিয়ে লিখবো, কোন ঘটনা বা ঘটনাবলী খুব
বেশি করে মনে পড়ে? হয়তো রাশিয়ায় থেকে যাবার ফলে এমন কি সোভিয়েত ইউনিয়ন নাই হয়ে যাবার
পরও দেশটাকে তেমন ভাবে মিস করি না যেমনটা করে আমার বন্ধুরা যারা এই দেশ ছেড়েছে অনেক
আগে। তারপরও সেই সময়ের কিছু জিনিষ খুব মিস করি। মস্কো মেলা
তাদের একটি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উদযাপিত সেই দিনটা একদিনের জন্য
হলেও যেন বাংলাদেশ হয়ে যেত। সারাদিন গান, বাজনা, কবিতা আবৃতিসহ
নানা ধরণের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাটতো দিনটি। অনুষ্ঠানের
ফাঁকে ইন্টারক্লাব থেকে যেতাম দুই নম্বরে নিজে ঘরে। রাস্তার দুপাশে
গোল গোল সাদা ফল আর তার উপর প্রথম বরফের আলতো ছোঁয়া। আজ আমাদের
নতুন জীবন, নতুন সংগঠন। তারপরেও মস্কো মেলাকে খুব বেশি করে মিস করি।
খুব মনে পড়ে অমলদার দেশে ফেরার দিনটির কথা। আমি তখন প্রথম
বর্ষের ছাত্র, অমলদা পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরছেন। উনি চলে গেলে
আমি ছিলাম ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে একমাত্র বাংলাদেশী। স্বাভাবিক
ভাবেই জানতে ইচ্ছে করছিলো কিছুদিন পরে যখন সুপারভাইজার ঠিক করতে হবে কার কাছে যাবো। অমলদা বললেন
- আমার গাইডের কাছে যেতে পারো। একেবারে মাটির
মানুষ। প্রচণ্ড অমায়িক। নাম ইউরি পেত্রোভিচ রীবাকভ। মনে থাকবে?
ইউরি গ্যাগারিন, পিটার দ্য গ্রেট আর রীবা মানে মাছ।
পরের দিন ফ্যাকাল্টিতে গিয়ে বোর্ডে ইউরি পেত্রোভিচের ছবি খুঁজে বের করলাম। আজ ২০১৭ সালেও
আমরা একসাথে। এখন একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করছি, মাঝে মধ্যে জয়েন্ট পেপার
লিখি। এখনও শুধু ফিজিক্সেরই নয়, ব্যক্তিগত কোন প্রশ্ন জাগলেও ওনার সাথে পরামর্শ করি। একেই হয়তো
বলে শিক্ষাপিতা।
আরেকদিনের কথা মনে পড়ে। মুর্তজা ভাই সেদিন দেশে ফিরছেন। উনি কিছু
দিন আমাদের পার্টি গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন, তাই অন্য ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যাবার আগে
আসলেন দুই নম্বরে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। হ্যান্ডশেক
করার সময় বললেন
- রেড ডিপ্লোমা পাওয়া চাই।
- ট্রাই করবো।
- তাই করবে? ব্যাপারটা এতো সহজ নয় কিন্তু!
বুঝলাম উনি ট্রাই শব্দটাকে ভুল শুনেছেন। আমি আর ওনাকে
না শুধরে বললাম
- তাই করবো মুর্তজা ভাই।
হ্যাঁ, আরও একটা কাজ বেড়ে গেলো, নিজেকে কথা দিতে হোল। আমি অবশ্য
কখনো অন্যকে কথা দেই না, কথা দেই নিজেকে আর চেষ্টা করি সেটা করতে। ওইদিন মুর্তজা
ভাইকে কথাটা না বললেও রেড ডিপ্লোমা পেতাম বলেই আমার বিশ্বাস, তবে ওই কথাটা এক ধরণের
জেদের জন্ম দিয়েছিল।
আমাদের ছাত্র জীবনে কিছু লোক রেগুলার লিখতো। আলোময়দা,
মেহেদি ভাই, ফারুক ভাই - এটা ডাক সাইটের কবি। আমি লিখতাম
ছড়া আর গল্প। তাই আলোময়দার সাথে প্রায়ই কথা হতো।
- তুমি তো গল্প লিখ। তোমাকে একটা থিম
দেই।
- বলুন।
- আমি দাঁড়িয়ে আছি ট্রাম স্টপেজে। হঠাৎ এক মেয়ে এসে বলল, “তুমি বাংলাদেশ থেকে? এই ছেলেটাকে
চেন?” “চিনি। কি হয়েছে?“ “এই যে প্যাকেট দেখছ, এটা ওকে পৌঁছে দিও।“ বলেই একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে
দিয়ে ও চলে গেলো।“ হোস্টেলে ফিরে
প্যাকেট খুলে দেখি ওর ভেতর ফুটফুটে এক বাচ্চা। মৃত।“
ওই গল্প আমার আর কোনদিন লেখা হয়নি। তবে পরবর্তী জীবনে
বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গল্পটা পথ দেখিয়েছে।
অনেক সময় ভাবি সব কি ঠিক করেছি আমি ওই দিনগুলোতে? না। অনেক ভুল
ছিল, অনেক ফানি কাজ করেছি। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়তো ১২০ দেশের
ছেলেমেয়ে। অনেক সুযোগ ছিল বিভিন্ন দেশের জীবন সম্পর্কে আরও জানার, সোভিয়েত
সমাজটাকেই আরও কাছ থেকে দেখার। তবে নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়েই সময়
কাটিয়েছি আমি। পেয়েছি অনেক আনন্দ, অনেক কষ্ট। তারপরেও সে
সবই আজ আমার কাছে এক অমুল্য ভাণ্ডার যা আমাকে আমি করেছে, আমার জীবনকে তিলে তিলে পূর্ণ
করেছে। আর তাইতো এখন এতদিন পরেও সেই সময়ের মানুষদের দেখার, তাদের কথা শোনার জন্য উদগ্রীব
থাকি।
কথা বেড়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে। ১০০০ শব্দের লিমিট
অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। ভাবছিলাম, দাঁড়ি কমা গুলো উঠিয়ে দিলে কেমন হয়? তাতেও
কুল রক্ষা হলো না। কী করা? যদি শব্দের মাঝের স্পেস ডিলিট করি তবে এটাকে একটা
শব্দ বলে চালিয়ে দিতে পারি। করবো কি? যাকগে। আমার কাজ
তো কথা বলা। যারা লেখা চাইছিল ওরাই না হয় কাজটা করুক। ওদের ধন্যবাদ
টাইম মেশিনে করে অতীতে ঘুরিয়ে আনানোর জন্য। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন,
রুশদেশ, রুশ ভাষা যাদের করেছে আমার আত্মার আত্মীয় তাদের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা।
দুবনা, ১২ – ১৩ অক্টোবর ২০১৭
Comments
Post a Comment