বাসা বদল

বাসা বদল বর্তমান জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ বাসা বদলায় বিভিন্ন কারণে, কেউ চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়, কেউ বা  অর্থনৈতিক কারণে বাসা বদলায়, কেউ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার সুযোগ সুবিধা মাথায় রেখে এটা করে। এক কথায় মানুষ যখন গ্রাম কেন্দ্রীক ছিল তখন পৈতৃক ভিটে শব্দটার যতটা আবেদন ছিল, শহুরে মানুষের বাড়ি ঘরের প্রতি সে আবেগ নেই। সে হিসেবী মানুষ। বাড়ি যতটা না ঐতিহ্য তার চেয়ে বেশী জীবন যুদ্ধে সাপ্লাই প্লেস যা নাকি শুধু মাথা গোঁজার ঠাই দেয় না, জীবনে উন্নতির জন্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। তাই জীবনের উন্নতি অবনতির সাথে তাল মিলিয়ে শহুরে মানুষ অনায়াসে বাড়ি বদলায়। তবে এটা ঠিক, বাড়ি বদলানো সব সময় ঝক্কিঝামেলার কাজ। রুশীরা বলে, দু বার বাড়ি বদলানো আর একবার বাড়িতে আগুন লেগে সর্বস্বান্ত হওয়া অনেকটা একই রকম।
আমার জীবনে বাসা বদল হয়েছে অনেকবার। তবে তখন জিনিষপত্র বলতে কিছু জামাকাপড়, অনেক বই, ক্যামেরা আর টুকিটাকি বাসনকোসন। তাই ঝামেলা হলেও সেটা ছিল ছোট্ট ঝামেলা। তাছাড়া সেটা ছিল ছোট থেকে বড় হওয়ার পথ, ছাত্র থেকে চাকুরীজীবী হওয়ার সোপান। তাই সে পরিবর্তনগুলো ছিল অভিপ্রেত। দুবনায় আসার পর যে দু’একবার বাসা পরিবর্তন করতে হয় সেখানে আমার সম্পৃক্ততা কম ছিল। ১৯৯৬ সালে গুলিয়া যখন আন্তন আর মনিকাকে নিয়ে দুবনা আসে, ওরা ছিল ছোট। বাচ্চাদের সুবিধা হল কোন জিনিষের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা গড়ে ওঠার আগেই সেগুলো ফেলে দিতে হয়। তাছাড়া সে সময় সংসার ছিল ছোট, জিনিষপত্র কম আর আমাদের ছিল ভরা যৌবন। তাই সে সময়ের বাসা বদল গায়ে লাগেনি। তাছাড়া মস্কোর বাসা আমাদের রয়েই গেছিল, আমরা শুধু দুবনায় থাকতে শুরু করি। ফলে জিনিষপত্র দুবনায় নিয়ে আসি ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১২ বছর ধরে। দুবনায় যখন এক বাসা থেকে আরেক বাসায় এলাম, সেটাও ছিল দুশ’ মিটারের ব্যাপার। তাই গায়ে লাগেনি। এর পরে মস্কোর এক বাসা থেকে অন্য বাসায় গেছে ওরা আমাকে ছাড়াই। মোদ্দা কথা আমি ছিলাম নিরব দর্শক। তাছাড়া অল্প বয়েসে ছেলেমেয়ারা নতুন কোথাও যেতে যত আগ্রহী হয়, যেভাবে হাত লাগিয়ে কাজ করে, একটু বড় হলে ওদের সে আগ্রহ থাকে না। তাই এবার যখন বাসা বদলের প্রশ্ন আসলো, ইচ্ছা অনিচ্ছায় আমাকেও হাত লাগাতে হল। কাজ যাতে এগুয় আমি অনেক আগে থেকে জিনিষপত্র একটু একটু করে দুবনায় নিয়ে আসতে শুরু করি। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। দুবনায় আমার বাসাটা অনেকটা গোডাউন মত। শীতের সময়ে বাচ্চাদের সামারের জিনিষ থাকে আর সামারে শীতের জামাকাপড়। আর আমি সময়ের সাথে তাল রেখে এগুলো  মস্কো-দুবনা-মস্কো আপ-ডাউন করাই।
নভেম্বরের শেষ বাসা বিক্রির কাগজপত্র চূড়ান্ত হল, আমি চলে গেলাম কাজানে একটা কনফারেন্সে। মোটামুটি জানা ছিল ডিসেম্বরের ১২ – ১৩ তারিখের দিকে বাসা ছেঁড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে ওরা জিনিষপত্র প্যাক করে রাখবে। মস্কো ফিরে দেখি যেভাবে রেখে গেছিলাম, সব সেভাবেই আছে। কারোই কোন মাথাব্যাথা নেই, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এর আগে সমস্ত বইপত্তর আমি প্যাকেট করে গেছিলাম। এ যেন সীমাহীন বইয়ের জগত। শুধু বই নয়, বাচ্চাদের ছোটবেলার খাতা। কী নেই সেখানে। এরপর শুরু হল জামাকাপড় প্যাকিংএর কাজ। তারপরে বাইরে থেকে লোকজন এসে ফার্নিচার প্যাক করবে। দেশে জানতাম মা দিদি বৌদির অন্তহীন শাড়ীর ব্যাপার। এখানে শাড়ী নেই, তবে দুই মেয়ের জামাকাপড় দেখে চোখ আমার ছানাবড়া। এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে এতো জিনিষ সেটা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আমি তো বউকে বলেই বসলাম
-    এরপর যদি বাসা বদলাতে চাও আগে থেকেই জিনিষপত্রের পরিমান জানিও।
-    কেন?
-    কেন আবার কী? আগে যদি জানতাম তোমাদের এতো জিনিষপত্র অন্য জায়গায় নিতে হবে, আমি বরং বউ চেঞ্জ করতাম।  
-    তা এখন করলেই তো হয়।
-    আমাকে ভুত পেয়েছ? সব কাজ করে এখন আমি সব ছেঁড়ে চলে যাই আর কী?
অবশ্য ব্যাপারটা শুধু এখানে নয়। আমি যাকে বলে টপ টু বোটম পদার্থবিদ। আমাদের কাছে কোন সমস্যার সামাধান না থাকাটাও সমাধান। কোন কাজ করতে গিয়ে আমরা যদি নেগেটিভ রেজাল্ট পাই তবে সেটা বাদ দিয়ে অন্য সমস্যা নিয়ে কাজ শুরু করি। তাই সংসার ভাঙ্গার আমার কাছে একটাই মানে – সংসার এটা আমার নয়। ফলে আর যাই হোক বউ চেঞ্জ হতো না, মানে সংসারের পাট ওখানেই ঘুচে যেতো। 
সারা ঘর ভরে জিনিষপত্র ছড়ানো। হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই, নতুন প্যাকিং তো দুরের কথা।
-    শোন, সব একসাথে পাঠানোর চিন্তা না করে কিছু কিছু করে বরং স্পোরতিভনায়া আর কানকোভা পাঠিয়ে দাও। আমিও সাথে করে কিছু দুবনা নিয়ে যাবো।
-    তাই করতে হবে। ট্যাক্সিতে স্পোরতিভনায়া যেতে ২৫০ রুবল নেয়। তুমি বরং চলে যাও যতটুকু পার তা নিয়ে। আন্তন ওখানে তোমাকে মিট করবে।
-    ঠিক আছে আছে। ঠিক কর কোন জিনিষগুলো ওখানে যাবে, এরপর ট্যাক্সি ডাকছি।       
ইয়ানডেক্স ট্যাক্সি ডাকা হল। দাম ৩০০ রুবলের মত। যাবো আমি আর সাথে অনেক জিনিষপত্র, মূলত মনিকার জামাকাপড়। যদি এতো জিনিষপত্র দেখে ড্রাইভার কিছু বলে, ওর হাতে শ’ খানেক রুবল ধরিয়ে দেব  এটাই ঠিক হল। ড্রাইভার ছিল মধ্য এশিয়ার। কিছুই বলল না এতো লাগেজ দেখে। আমদের যাত্রা হল শুরু। আমাদের বাসা থেকে জায়গাটা বেশি দূরে নয়। আগে, যখন দিমিত্রি উলিয়ানভ রাস্তা থেকে ইউনিভার্সিটি প্রোসপেক্ট ধরে ভেরনাদস্কী প্রোসপেক্ট হয়ে যেতে হতো, সময় লাগত। এখন তৃতীয় সার্কেল লাইন হবার ফলে দুরত্ব কমে গেছে। তবে ড্রাইভার ভুল করে অন্য গলিতে ঢুকে পড়ায় আমাদের কয়েক কিলোমিটার অতিরিক্ত যেতে হল। ও বললও       
-    এটা আমার দোষ। তোমাকে এক্সট্রা পয়সা দিতে হবে না।
আমি কোন গাড়িতে একা গেলে যদি ড্রাইভার কথা বলতে চায়, গল্প করি, নইলে বই পড়ি।  ও এসেছে তাজিকিস্তান থেকে। এখানে বেশ কয়েক বছর। আগে কাজ করতো কনসট্রাকশনে, এখন গাড়ি চালায়। এখানে থাকে বউ নিয়ে, মস্কোর বাইরে। দেশে বাবা মা আছে। আগে দেশে যেতো, এখন আর হয়ে ওঠে না। বয়েস বিশের কোঠায় হলেও জীবনে অভিজ্ঞতা কম হয় নি। গল্প করতে করতে চলে এলাম আমার আস্তানায়। জিনিষপত্র নামিয়ে দিয়ে ও চলে গেলো। আন্তন ওগুলো নিয়ে গেলো বাসায় আর আমি চললাম আমার কাজে। পরের দিন ড্রাইভার ছিল এক রুশ ছেলে, ভ্লাদিমির থেকে। সেও কোন ঝামেলা না করে আমাকে নিয়ে এল নতুন বাসায়। শুধু তাই নয়, ও দিন কানকোভার বাসা থেকে আমাদের বেশ কিছু জিনিষপত্র আনার ছিল। যাতে ডাবল পে করতে না হয় ও বলে দিল কখন ও ঐ এলাকায় থাকবে, যাতে সেসব নিয়ে আসতে পারে। তৃতীয় দিন এল এক ছেলে। সবারই বয়েস বিশ থেকে তিরিশের মধ্যে। দেখেই মনে হল জামাতের। মানে ঐ রকম দাঁড়ি, চলার হাবভাব তেমনি, মধ্য এশিয়ার, খুব সম্ভব উজবেক। এসেই বললো
-    এত্ত জিনিষ! আমি যাবো না।
-    অন্য গাড়ি ডাকবো?
-    যদি ১০০ রুবল এক্সট্রা দাও, যেতে পারি।
একবার ইচ্ছে হচ্ছিলো সেটাই করি। ব্যাপারটা রুবলে নয়, ওর ভাবভঙ্গিতে। আবার ভাবলাম, কি লাভ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে? চলেই যাই। আগের দু’জনের সাথে যদি আমি নিজে যেচেই কথা বলছিলাম, ওর সাথে সে ইচ্ছেটা জাগলো না। ও নিজেই শুরু করল
-    বাসা বদলাচ্ছেন?
-    হ্যাঁ।
-    আপনি কোন দেশ থেকে?
-    বাংলাদেশ থেকে।
ভাবছিলাম, এই জিজ্ঞেস করবে আমি মুসলিম কি না? আসলে মধ্য এশিয়ায় লোকজন বাংলাদেশ শুনলেই এই প্রশ্ন করে। না, সে ঐ প্রশ্ন করল না। জিজ্ঞেস করল
-    আপনি কি করেন, মানে আপনার প্রফেশন কি?
-    আমি বিজ্ঞানী, রিসার্চ ইন্সিটিউটে কাজ করি।
-    ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
-    ঈশ্বর মানে তুমি বলতে চাইছ সৃষ্টিকর্তা, তাই?
-    হ্যাঁ।
-    এই যে তুমি গাড়ি চালাচ্ছ, তুমি কি জান কে এই গাড়ি তৈরি করেছে? ধরে নিলাম জান। কিন্তু না জানলেও অসুবিধা ছিল না যদি তুমি গাড়ি চালাতে পার। আসল যেটা জানা দরকার সেটা হল গাড়ির কলকব্জা কিভাবে কাজ করে। আমার কাজ এই মহাবিশ্ব কেন এবং কিভাবে কাজ করে সেটা জানা। এরপর যদি সময় পাই, জানার চেষ্টা করবো কে তার সৃষ্টিকর্তা।
-    আপনার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো লোক কে?
-    দেখো, ভালোমন্দ ব্যাপারটা ব্যক্তিগত, নির্ভর করে  তুমি কোন লোককে কিভাবে নিচ্ছ।  তোমার কাছে যে ভালো, আমার কাছে সে ভালো নাও হতে পারে।
-    না, আমি বলছিলাম, যদি একজন লোকের নাম করতে বলা হয় যিনি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন, আপনি কার কথা বলবেন।
-    এটাও আপেক্ষিক। অনেক সেনানায়ক, অনেক রাজনীতিবিদ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন বারবার। অনেক লেখক আছেন যাদের লেখা সমাজ বদলেছে। তেমনি আছেন অনেক বিজ্ঞানী। তবে যেহেতু আমি বিজ্ঞানের লোক, আমি আইনস্টাইনকে সে রকম একজন বলে মনে করি। উনি আমাদের চিন্তার ধারাকে বদলে দিয়েছেন। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছেন।  আর নিজের সাফল্যে অন্যদের অবদান স্বীকার করতে ভুলেন নি।
-    কিন্তু কয়জন লোক তার ডাকে আসে?
-    উনি তো কাউকে ডাকেন নি। উনি নিজের কাজ করে গেছেন। এই যে আজ আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে এতো এগিয়ে গেছি তার পেছনে ওনার হাত আছে। এটাও তো কোন না কোনভাবে তাকেই অনুসরণ করা।   
-    আমার মতে হযরত মোহাম্মদ শ্রেষ্ঠ মানব। তার ডাকে এখন বিলিয়ন মানুষ একত্রিত হয়।
-    সেটা আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। তবে কে বড় কে ছোট সেটা খুব আপেক্ষিক। তুমি ভালো গাড়ি চালাও, আমি ভালো অংক কষি। আমাদের মধ্য কে শ্রেষ্ঠ? সেটা নির্ভর করে কোন পরিস্থিতে কোন বিষয়ে কথা হচ্ছে। আরও একটা সমস্যা কী জান? আইনস্টাইনকে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করতে হয় না। তার অনুসারীরাও সেটা করে না। কিন্তু ইরাক সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ধর্মের নামে লাখ লাখ মানুষ খুন হচ্ছে। শুধু ইসলাম কেন? অন্যান্য ধর্মও কম যাচ্ছে না। বিজ্ঞানের সাথে তোমাদের এখানেই পার্থক্য। আমাদের কাউকে মেরে কিছু প্রমান করতে হয় না। আমরা মানব জাতির কল্যানের জন্য নীরবে কাজ করে যাই। তার সুফল সবাই ভোগ করে। এমনকি তুমিও, যে বিজ্ঞানকে, বৈজ্ঞানিক মতবাদকে মানতে চায় না।  
-    তারপরেও আমি মনে করি আমাদের নবী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব।
-    তুমি সেটা ভাবতেই পার। এতে আমার কিন্তু কোন আপত্তি নেই। তার উপর তিনি বাঙ্গালী নন।
-    হ্যা, উনি আরব দেশের মানুষ। আরবে তার জন্ম।
-    আমি জানি।
এরই মধ্যে আমরা চলে এলাম গন্তব্যে। গাড়ির ভাড়া অন লাইনে পে করা ছিল। আমি ওর হাতে ১০০ রুবলের নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম
-    এই দেখো, তুমি ধর্মের কথা বল, ন্যায়ের কথা বল। তোমার নবীর কথা বললে। গত দু’ দিন আমি দু’ বার এখানে এসেছি এরকম জিনিষপত্র নিয়ে। ওরাও তোমার বয়েসী ছিল। ধর্ম, ন্যায়, অন্যায় এসব নিয়ে কথা বলে নি। জীবনের গল্প করতে করতে এসেছি আমরা। আর ওরা আমার কাছ থেকে একটা রুবলও বেশি চায়নি। তুমি কি করলে? এসে প্রথমেই ১০০ রুবল এক্সট্রা দাবী করলে আর সারা পথ ধর্ম আর ন্যায়ের বানী শোনালে।  হয়তো ইসলামিক স্টেট বা অন্য কোন ফান্ডে এই ১০০ রুবল দিয়ে তুমি ওদের কাজকে এগিয়ে নেবে, কিন্তু ধর্ম বা ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তোমার এ কাজ তোমাকে এক চুলও  সামনে নেবে না।
দুবনা, ২৪ জানুয়ারী ২০১৮               



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি