ঈশ্বরের বন্ধু

তুমি মনিকা ক্রিস্টিনাকে বলতে পার না বিড়ালদের একটু দেখভাল করতে।

বিকেলে বাসায় চা খেতে খেতে গুলিয়া বলল।

ওরা যে বিড়ালদের দেখাশুনা করে না সেটা নয়। মনিকার বিড়াল সারাদিন জানালায় বসে ওর অপেক্ষা করে আর মনিকাকে দেখলেই ম্যাউ ম্যাউ করতে করতে দরজার কাছে দৌড়ে যায়।

ক্রিস্টিনার বিড়ালও কম নয়। সেভার কুকুর সম্বন্ধেও একই কথা। ওরা কুকুর বিড়াল নিয়ে খায়, ঘুমায়। কিন্তু সমস্যা হল বিড়াল কুকুর শুধু খায় ঘুমায় না আর ওদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বা গাল চেটে ভালবাসাই জানায় না, প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দেয়। আর এখানেই সব সমস্যা। তখন শুরু হয় কার বিড়াল এটা করল বা কার কুকুর। আমি বা গুলিয়া মস্কো গেলে পরিস্কার করে দিই, কিন্তু আমরা তো আর সব সময় ওখানে থাকি না।

পাপ, আমি টায়ার্ড। মনিকা আর ক্রিস্টিনা কখনও বিড়ালদের টয়লেট পরিস্কার করে না, একে অন্যকে দোষ দেয়। তুমি কিছু বলতে পার না?

সেভা গভীর রাতে তার গেম শেষ করে নালিশ করল। আমি পড়ছিলাম।

সেভ, আমি পড়ছি। তোর অন্য কোন কথা আছে?

তোমাকে এসব বললেই তুমি কাজে ব্যস্ত।

দেখ, তুই যেমন ওদের নামে অভিযোগ করিস, মনিকা, ক্রিস্টিনাও সেটা করে। তোরা একে অন্যের দোষ দেখিস। আমি যদি তোকে কিছু করতে বলি, তুই করবি?

আমি কেন করব? বিড়াল কি আমার?

ওরা বলে কুকুর কি ওদের? সবাই যদি নালিশ না করার অপেক্ষায় থেকে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় এসে কাজগুলো করিস, তাহলে এ ঝামেলা হয়না।

আসলে তুমি ওদের বকতে চাও না তাই বল।

ব্যাপারটা বকা বা না বকায় না। বকলে কোন কাজ হয়? যত দিন কেউ নিজে থেকে না বুঝবে বকাবকি করে কোন লাভ হবে না। শুধু আমার সময় নষ্ট আর মেজাজ খারাপ। আমি যখন হোস্টেলে ছিলাম তখন আমাদের রুটিন ছিল। দরজায় ঝোলান ওই রুটিনে লেখা ছিল কে কবে ঘর পরিস্কার করবে। তোরা সেটা করলেই পারিস।

ক্রিস্টিনা করে না।

ও সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত ব্যস্ত। আমি এলে তো পরিস্কার করিই। মামাও করে। তুই আর মনিকা করলেই তো হয়।

ক্রিস্টিনা না করলে আমরা করব কেন?

তাহলে আর কি? অপেক্ষা করে বসে থাক কবে আমি আসব। যাকগে, আমি একটু পড়ছি। কাল কথা বলব।


২০০৬ সাল। এপ্রিলের শেষ দিক। ক' দিন আগেই (২৬ মার্চ) ইনস্টিটিউট পঞ্চাশে পা রেখেছে।তখনও ভল্গার তীরে বরফ জমে আছে। হঠাৎ ফোন এলো ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টরের অফিস থেকে।

বাংলাদেশ থেকে প্রোফেসর শমসের আলী এসেছেন দুবনায়। প্রফেসর সিসাকিয়ান চাইছেন তুমি তাঁদের মিটিংএ থাক আর তাঁদের সাথে লাঞ্চ কর।

আমি এসব কাজকর্ম মানে বসদের সাথে মাখামাখি একেবারেই পছন্দ করি না। কিন্তু কি আর করা।

মিটিং শেষ। তেমন কিছুই নয়, তবে তখন থেকেই আমাদের ইনস্টিটিউটের নজরে এল বাংলাদেশ। আর সে কারণে পরবর্তীতে আমার কয়েকবার দেশ ভ্রমণ। এরপর লাঞ্চের পালা। সবাই যে যেটা পছন্দ অর্ডার দিচ্ছে। আমি এর আগে প্রোফেসর আলী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যখন পানীয় অর্ডার দেওয়ার সময় এলো, আমি কনিয়াকের কথা বললাম, উনি ফলের রস। কথায় কথায় বিশ্বাসের কথা উঠল, মানে ঈশ্বর বিশ্বাসের কথা। আমাদের ডাইরেক্টর প্রোফেসর সিসাকিয়ান আমাকে জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম

ঈশ্বর আমার বন্ধু!

মানে?

আমরা একে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাব না বলে চুক্তি করেছি।

ঈশ্বরের কোন আত্মীয় বা বন্ধু নেই। আপনি ঈশ্বরের বন্ধু হতে পারেন না। - পাশ থেকে বলে উঠলেন প্রোফেসর আলী।

এটা কিন্তু ঈশ্বরের সমস্যা। - আমি কথা না বাড়িয়ে এ আলোচনার ইতি টানলাম। একটা থমথমে আবহাওয়ার তৈরি হল।

আমার উপর দায়িত্ব ছিল প্রোফেসর আলীর সাথে যোগাযোগ করা আর বাংলাদেশ ও জেআইএনআর (জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ) মধ্যে কোলাবরেশনের ভিত্তি তৈরি করা। আমি ওনাকে বেশ কয়েকবার মেইল করে উত্তর পাইনি। পরে শুনেছি উনি এখন পদার্থবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন না, কাজ করেন ধর্ম নিয়ে।

বৌ ছেলেমেয়েদের সাথে আমার সম্পর্কের এক বিশেষ দিক ওরা আমার কাছে হয় টাকাপয়সা চায় নয়তো অভিযোগ করে। শুনেছি ধার্মিকেরাও ভগবানের কাছে হয় ধনদৌলত, সুখ শান্তি ইত্যাদি চায়, নয়তো পড়শির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে। কে জানে, বৌ ছেলেমেয়েরা আমাকে ভগবানের বন্ধু থেকে প্রোমোশন দিয়ে ভগবান বানিয়ে দিয়েছে কি না? কথায় আছে ত্রুদনা বিচ বগম (Тудно Быть Богом - Братья Стругацких) মানে ঈশ্বর হওয়া কঠিন।

ঝামেলা!

দুবনা, ১১ মার্চ ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা