উড়ে খই গবিন্দায় নম!


রাত একটার দিকে গিন্নির ফোন এল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। না, আমি সাধারণত এত আগে ঘুমুই না, তবে গুলিয়া মস্কো গেলে আগেই শুয়ে পড়ি। যতক্ষণ আলো জ্বলে, কুকুরগুলো বড় অশান্তি দেয়। বউ বাসায় থাকলে ও সামলায়। ও না থাকলে আমি নিজেই শান্ত হয়ে যাই, যাতে ওরা প্রতিবেশিদের ঘুম না ভাঙ্গায়।
- তুমি যে ব্যাগ দিয়েছিল, তাতে কি ছিল?
- কালবাছা (সসেজ), রেড ফিস, রুটি আর আলু-মাংস। কেন?
- আমি ট্রেনে বা মেট্রোতে ব্যাগটা ভুলে রেখে এসেছি।
অফিস থেকে গতকাল বাড়ি ফিরি একটু আগেই। আসলে ঝামেলা হয়েছে আগের রাতে, কোন কারণে ঘড়ির কাটা এক ঘণ্টা আগে চলে এসেছে। আমি যখন ডাক্তারের কাছে গেলাম, উনি বললেন, "আজ লোকজন কম, ভালোই করেছ আগে চলে এসে।" আমি ওটাকে গুরুত্ব দিইনি। অফিসে আসার পর ত্রম্ব্যক ফোন করল। "আমি তিনটের সময় আপনার ওখানে আসব। আপনি ফ্রী থাকবেন তো?" "অবশ্যই। চলে এসো।" স্মার্ট ফোনে তিনটে বাজে। আমার চা খাওয়ার সময়। ওর খবর নেই। কম্পিউটারে দেখি দুটো বাজে। ভাবলাম, ওখানেই কোন ঝামেলা। ঘণ্টা খানেক পরে ত্র্যম্বক এল। "কটা বাজে?" "তিনটে।" "আশ্চর্য!" অনেকক্ষণ গল্প হল। শুরু হল বিভিন্ন বই দিয়ে। এরপর রাজনীতি, ওর মুখেই শুনলাম কোলকাতায় এখনও বিয়ের চিঠিতে অনেকেই লিখেন "যশোর নিবাসী অমুকের পুত্র ইত্যাদি।" কথা হল দেশ ভাগ নিয়ে আর আমরা বাঙ্গালীরা এখনও গ্রামের বাড়িকেই বাড়ি আর শহর বা ভিন দেশের বাড়িকে বাসা মনে করি" এসব নিয়ে। ও চলে গেলে কিছু কাজ করলাম, কিন্তু ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো। এমন তো হয় না। যাহোক, সাড়ে সাতটায় উঠলাম বাসায় ফিরব বলে। পাশের রুমে দেখি লোকজন। ওরা সাধারণত আগেই চলে যায়। আমি অনেক দেরি করে যারা ঘরে ফেরে তাদের একজন। গেটে এসে দেখি, দুটো দরজাই খোলা। একটা ৭ টায় বন্ধ হবার কথা। বাইরে গিয়ে গেটের ঘড়িতে দেখি সাড়ে ৬ টা বাজে। এতক্ষণে বুঝলাম আমার দিন শুরু হয়েছে একঘণ্টা আগে আর তাই সব কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে।
বাসায় এলে গুলিয়া বলল ও রাত দশটার ট্রেনে মস্কো যাবে। কোথায় যেন সোভিয়েত আমলের কিছু কাপ আর ক্রিস্টালের বাকাল (শ্যাম্পেন খাওয়ার গ্লাস) এর সন্ধান পেয়েছে, সকালে দেখা করে নিতে হবে। এটা এদেশের লোকদের এক বদ অভ্যাস। পড়ুক আর নাই পড়ুক, খাক আর নাই খাক, ঘর ভরা বই, ডাইনিং সেট, টি সেট, কফি সেট আর ভদকা, ওয়াইন, শ্যাম্পেন এসবের জন্য বিভিন্ন রকমের গ্লাস রাখা। ফলে বাসার একটা বিরাট স্পেস চলে যায় এসবের জন্য। আমি তো অনেকদিন কোন বইই কিনি না রাখার জায়গা নেই বলে। পড়ি ই-বুক।
সেভা ফোন করেছিলো। বলেছে খাবার কিনতে।
কি খাবার।
টেস্টি কিছু।
এই এক ঝামেলা। কি বউ, কি ছেলেমেয়েরা প্রায়ই ফোন করে বলে কিছু ফকুস্নিয়াতিনা (মানে টেস্টি কিছু) কিনতে। আমি জিজ্ঞেস করি, ঠিক কি কিনতে হবে। কেননা আমার যেটা পছন্দ ওদের সেটা নাও হতে পারে। কিন্তু কেউই কখনো কোন উত্তর দেয় না।
কিছু চাইলে রাঁধতে পার।
আমি দোকানে গিয়ে এক ছড়া কালবাছা (সাধারণত স্লাইজ করা কিনি, সেদিন টিভিতে দেখলাম, স্লাইজ করা কালবাছায় যে ডেট থাকে সেটা ফ্যাক্টরির ডেট নাও হতে পারে, তাই এটা কেনা), কিছু রেড ফিস, রুটি কিনে আনলাম আর আনলাম মুরগী। বাসায় এসে আলু দিয়ে মুরগী কষালাম আর সব প্যাকেট করে ব্যাগে ভরে দিলাম। তখন গুলিয়া বলল, "যেতে ইচ্ছে করছে না, কাল ভোর ৬ টার ট্রেনে গেলে কেমন হয়।" "যা খুশি কর। খাবার রেডি।" এ কারণেই অনিচ্ছা স্বত্বেও ও চলে গেল। তারপর এই ফোন।
- কি আর করা।
- না, তুমি দেখ হারানো জিনিসের খোঁজ কোথায় নিতে হয়।
যদিও বললাম কি আর করা, মেজাজটা ঠিকই খারাপ হয়েছিল। না না, খাবারের জন্য নয়, সেটা চাইলেই কেনা যেত। কিন্তু ওর মধ্যে যে ভালবাসাটুকু ছিল তার জন্য। আমি জানি, আমি নিজের ব্যাগ ভুলে গেলেও এই ব্যাগটা ভুলতাম না। যাকগে, তখনই খুঁজে পেতে টেলিফোনগুলো বের করে ওকে পাঠালাম। সকালে ফোন
- আমি ওসব খুঁজতে যাব না।
আমি এগুলো একেবারে পছন্দ করি না, মানে ইনডিসিশন। তোমাকে তো বাবা কেউ খুঁজতে বলেনি। তাহলে এই টেলিফোন চাওয়ারই বা কি দরকার ছিল। একটু বিরক্ত হয়েই বললাম
- যেমন খুশি।
ঘণ্টা দুই পরে আবার ফোন
- আমি ফোন করেছিলাম, কেউ কিছু জমা দেয়নি। আর মেট্রো ষ্টেশনে বলল এসব সাধারণত বোমঝ বা গৃহহীনরা নিয়ে যায়। যদি বোমঝরা নেয়, আমি বরং খুশি। বাচ্চারা না খেয়ে থাকে না, ওদের না হয় একটু খাবার জুটল।
মনে পড়ল ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা গল্পঃ
এক লোকের ছেলের অসুখ। কিছুতেই সারছে না। সে তখন ভগবানকে ডেকে বলল, "হে ভগবান, আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও। আমি তোমাকে পাঁঠা দান করব।"
ছেলে সুস্থ হল। ভগবান পাঁঠার অপেক্ষায় বসে রইলেন। কিন্তু পাঁঠার কোন খবর নেই। ভগবান স্বপ্নে বললেন, "কিরে, আমার পাঁঠা কোথায়?" সে লোক স্বপ্ন দেখে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে আর কি! বলল, "ভগবান, আজকের বাজারে পাঁঠা দানের সামর্থ্য আমার নেই। আমি বরং তোমাকে মুরগী দান করব।" "তথাস্তু" বলে ভগবান অদৃশ্য হলেন।
দিন যায়, কিন্তু মুরগীর দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে ভগবান আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন। "কিরে, মুরগী কি বিদেশ থেকে আসছে? এত সময় লাগছে কেন?" "ভগবান, আজকাল মুরগীও আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি বরং তোমাকে একটা ফরিং দেব।" "তথাস্তু" বলে ভগবান অনন্ত নাগের শয্যায় ঘুমিয়ে পড়লেন।
দিন যায়। ফরিংএর দেখা নেই। একটু রেগেই গেলেন ভগবান। স্বপ্নে এসে বললেন "কিরে, ফরিংএর কী হল।" "চারিদিকে এতো ফরিং উড়ে বেড়ায়, তুমি কি নিজে একটা ফরিং ধরে খেতে পার না?" আরও বেশি রাগ দেখিয়ে উত্তর দিল ঐ লোকটা।
পরদিন সে যখন সকালে বারান্দায় বসে খই খাচ্ছিল, কোথা থেকে দমকা বাতাস এসে খই উড়িয়ে নিয়ে গেল। ঐ লোক কিছুক্ষণ দৌড়ে যখন দেখল খই পাওয়ার আর আশা নেই, ভগবান যাতে শুনতে পায় সেভাবে জোরে চিৎকার করে বলল "উড়ে খই গবিন্দায় নম।"
দুবনা, ০৬ মার্চ ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা