ঘরে বাইরে

গত বুধবার মানে ২৫ মার্চ সারাদিন ঘরে বসেই কাটল। সকালে মনিকা বাইরে গেছিল, বলল এসে খরগোশ রান্না করবে। আমিও ওটাকে ফ্রিজ থেকে বের করে আলু কেটে বসে রইলাম। দুপুরে বাসার ফিরে জানাল আবার কি কাজে বাইরে যাবে, তাই রাঁধতে পারবে না। খরগোশটা ছিল ক্রিস্টিনার কেনা। জিজ্ঞেস করলাম

আমি মুরগীর মত করে খরগোশটা  রাঁধ?
খরগোশ কিনলাম খরগোশ খাওয়ার জন্য, তুমি ওকে মুরগীর স্বাদে রাঁধলে কিনে কি লাভ হল?
মুরগীর স্বাদ হবে কেন? মুরগী যেভাবে রান্না করি সেভাবে করব।
মনিকা বলেছিল ওভেনে করবে। তুমি পার?
না। আগে কখনও খরগোশ রান্না করেছে?
না। তবে ইউ টিউবে দেখে করতে পারবে বলল।
আমি ছাত্র জীবনে বার দুয়েক খরগোশ রান্না করেছি। ইউ টিউব না দেখেই পারব।
কর তাহলে

ভয়ে ভয়ে রান্না শুরু করলাম। যাতে আম ছালা দুই না হারাই দুটো প্যাকেটের একটা উল্টো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলাম। ভয়টা এই, পুড়ে না যায় আবার। বৌয়ের সাথে এসব হলে পাসপোর্টে বিয়ের সীল দেখিয়ে বলি "এই দেখ, সরকার আমাকে এসব করার অধিকার দিয়েছে।" মেয়েদের সাথে এসব চালাকি খাটবে না। রান্না শেষের পথে। দেখি ক্রিস্টিনা জামা কাপড় পরে রেডি।

কোথায় যাচ্ছিস?
একটু হেঁটে আসি। সারাদিন তো ঘরেই বসা।

এর মধ্যে রান্না শেষ। আমি আর সেভা খেয়ে নিলাম। সেভার পছন্দ। ভালই নাকি হয়েছে। অবশ্য রান্না খারাপ হলেও আমাকে বলে না। তবে মা যাই রান্না করুক  সব সময়ই কোন না কোন খুঁত ধরে

রাত  তখন ১১ টা। ক্রিস্টিনার খবর নেই। ফোন করলাম, উত্তর নেই। কিছুক্ষণ পরে ওর ফোন এলো।

তুই কোথায়?
হাঁটতে হাঁটতে পার্ক কুলতুরি চলে এসেছি, এখন নদীর ধার দিয়ে হাঁটছি লুঝনিকির দিকে, ওখানে ব্রীজ ক্রস করে বাড়ি ফিরব।

যারা মস্কো চেনে, বুঝবে রাস্তা খুব কম নয়, কয়েক কিলোমিটার। তার উপর রাত।

এত রাতে ওদিকে না গেলেই পারতি।
কোন লোকজন নেই। ভয় করো না।
কি আর করা, ভয় নেই, তবে টেনশন ছিল। আমি কোন দিন রাস্তায় হাঁটিনি, তবে ১৯৯১- ৯৩ তে রাত একটা দুটোর দিকেও দ্বিজেন কাকুর বাসায় আড্ডা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরেছি। নিয়ে কিছু বলে লাভ নেই, শুনবে না। আর মনে যদি ভয় ঢুকে যায়, সেটা আরও খারাপ।

এর মধ্যে মনিকা এসেছে। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। বলল ক্লান্ত। খাবে না। ক্রিস্টিনা ফিরল বারোটার পরে।  বললাম

খরগোশ রেডি। খেয়ে নে।
একটু পরে খাচ্ছি।
ঠিক আছে বেড়ে নিস। আমি ঘরে চলে গেলাম। বই পড়তে পড়তে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে দেখি খায়নি। চা খেয়ে আমি চলে গেলাম মিকলুখো মাকলায়া। গিয়ে দেখি  ডাক্তারের দরজায় লেখা করোনা ভাইরাসের কারণে উনি এখন এসব কাজ করবেন না। রেক্টরের নির্দেশে তার রুগী দেখা বন্ধ। ভারী ঝামেলা। সার্টিফিকেট না পেলে ডকুমেন্ট জমা দিতে পারব না। দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি কি করব, এক ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন আমার দাঁড়িয়ে থাকার কারণ। সব শুনে বললেন রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিতে। সব শুনে  বললেন,

আগামী কাল আসুন। আমি কাগজ রেডি করে রাখব।
দেখুন, আমাকে দুবনা ফিরতে হবে। আজ বিকেলে সম্ভব?
ঠিক আছে আমি সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত এখানে থাকব। চারটের পরে ফোন করেন।

তাকে ধন্যবাদ বলে বাসায় ফিরলাম, দেখি মেয়েরা ঘুমে। আমি একটু ভাত বসালাম আর মুরগী। মনিকাকে জিজ্ঞেস করলাম খরগোশ খাবে কি না।

ঠিক আছে দাও।

একটা কাজ হল। বাকি রইল ক্রিস্টিনা।

ক্রিস্টিনা, ওঠ, খেয়ে নে।
এখন খাব না। ভালো লাগছে না।

এর মধ্যে মুরগী ভাত য়ে গেল। বাসায় তেল ছিল না। আমিও কিনতে ভুলে গেছি। তাই ক্রিস্টিনার মত করে তেল ছাড়াই রান্না করলাম। গুলিয়াও তেল পছন্দ করে না। নিজে খেলাম। সেভাকে খাওয়ালাম। ঘড়িতে তিনটে। ক্রিস্টিনাকে আবার জিজ্ঞেস করে চলে গেলাম মিকলুখো মাকলায়া। উনি আমাকে দেখেই কাগজটা করে দিলেন। গেলাম সুপার মার্কেটে ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু কেনাকাটা করে দুবনা ফিরব বলে। আমি আসার সময় ক্রিস্টিনার কার্ড নিয়ে এসেছিলাম।

পাপা, তুমি কখন আসবে?
কেন?
আমি আর মনিকা বাইরে যাব। তুমি আমার কার্ড নিয়ে গেছ।
ঘণ্টা খানেক পরে। তোর খাবার মাইক্রোওভেনে। খেয়ে নে এই সময়ে।

আমি লুঝনিকি স্টেশন থেকে বেরিয়ে যখন বাসার দিকে হাঁটছি দেখি মনিকা আর ক্রিস্টিনা আসছে। ক্রিস্টিনাকে কার্ড দিলাম।

দেখিস, বেশিক্ষণ বাইরে থাকিস না। আমি সাতটার দিকে বেরুব। তাড়াতাড়ি ফিরিস।
আমাদের কিছু হবে না। ভাইরাস বয়স্কদের জন্য মারাত্মক।

গুলিয়া যখন বলে «আমার মনে হয় করোনা» আমি বলি «পঁয়ষট্টিতে পা দিতে তোমার এখনও অনেক দূর। ভয় নেই, মরবে না।« মেয়েদের এটা বলা যায় না। তাই বললাম

আমি তো আর তোদের মত ভাইরাস প্রুফ নই। দেখিস এটা যেন আমাদের শেষ দেখা না হয়।

বাসায় ফিরে দেখি ক্রিস্টিনার খাবার তেমনি পড়ে আছে। সালাদটা আর রাখা যায় না, তাই ওটা খেয়ে নিলাম আর ওদের জন্য নতুন করে সালাদ করলাম। সেভা যাবে আমাকে এগিয়ে দিতে। সাধারণত হাতে ভারী কিছু থাকলে নিজে থেকেই আসে, কখনও মেট্রো  স্পোরচিভভনায়া পর্যন্ত, কখনও বারাভিতস্কায়া। আমার মনে পড়ল বাবা যখন নারায়ণগঞ্জ মোকামে যেতেন আমিও বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিতাম। বাবা প্রায়ই কিছু না কিছু ভুলে ফেলে যেতেন। বাবা বেরুলে মা এসব দেখে আমাদের কাউকে পাঠাতেন। সে সময় পেছন থেকে ডাকা নিষেধ ছিল, তাতে নাকি অমঙ্গল হয়, যাত্রায় বাধা পড়ে। তাই দৌড়িয়ে বাবার পাশে গিয়ে সেসব দিতাম। বাবা অবশ্য কারও আসার শব্দ পেলেই পেছনে ফিরে তাকাতেন, দাঁড়াতেন।

সাথে ছিল সাড়ে আট কেজি করে দু প্যাকেট কুকুরের খাবার সেভাকে যেতে যেতে বললাম ঘর থেকে না বেরুতে। ওকে নিয়ে ঝামেলা নেই। এমনিতেই বাইরে যায় না। সারাদিন গেম খেলে। এখন তো আমরাই চাই ঘরে থাকুক।       

আমাকে বারাভিতস্কায়া মেট্রো পর্যন্ত এগিয়ে দিল। পথে যেতে যেতে সেভা বলল

তোমার আর আসার দরকার নেই। তুমি চেষ্টা কর বাসায় থাকতে।
যদি খারাপ লাগে দুবনা চলে আসিস।
ঠিক আছে।
কে জানে কবে আবার দেখা হবে। আবার হবে কিনা? আমি তোকে প্রচণ্ড ভালবাসি।

বুঝলাম আমি একটু সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছি। সেভা কিছু না বলে তাড়াতাড়ি চলে গেল। আমি হলেও তাই হয়তো করতাম।

ট্রেনে যেতে যেতে মনে পড়ল ওদের জন্মের আগের কথা। প্রযুক্তির কারণে আমরা আগে থেকেই জানতাম ছেলে না মেয়ে কে আসছে। ওদের নাম আগে থেকেই ঠিক হত। আর নাম ঠিক হলে আমরা অনাগত শিশুকে সে নামেই ডাকতাম গুলিয়ার পেটে যখন ওরা হেঁটে বেড়াত, পা দিয়ে গুতাতো, আমরা দুজনে চেষ্টা করতাম ওদের ধরতে। আর প্রতিবার যখন গুলিয়াকে মাতৃসদনে রেখে আসতাম আমার সব শেষ কথা ছিল

যদি প্রশ্ন আসে, মা না সন্তান, মা থাকবে। মা থাকলে সন্তান আরও হবে। এগুলো ছিল আমার উচ্চারিত সবচেয়ে কঠিন শব্দ, ঠিক যেমনটা সেদিন সেভার সাথে বিদায়ের কালে বললাম।   

দুবনা, ২৯ মার্চ ২০২০




 

  

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা