ঘরে থাকা ঘোরে থাকা

২০১৪ সালে পুনার ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর আস্ট্রোনমি এন্ড আস্ট্রোফিজিক্স -এ ছিলাম দিন দশেক। সবই ঠিকঠাক, একটাই সমস্যা, ওখানকার ক্যান্টিনে সপ্তাহে মাত্র দু'দিন মাংস দেয়, তাও প্রি-অর্ডারে। আমি যে মাংস ছাড়া থাকতে পারি না তা নয়, এমন কি ইচ্ছে হলে দিনের পর দিন নিরামিষ খেয়ে কাটাই। কিন্তু ওই যে চাইলেই পাচ্ছি না, সেটাই আমার মাথা খারাপ করে দিল। ওতে আমার স্বাধীনতা খর্ব হয়েছিল। এখন করোনার কারণে সবাই বলছে বাসায় থাকতে। ফেসবুক উপদেশে সয়লাব। এমনও হয় আমি মাঝে মধ্যে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকি। নিজের কাজ (রিসার্চ), বই পড়া, ছবি তোলা (আমি প্রায়ই স্টিল লাইফ, আবস্ট্রাক্ট, এক্সপ্রেরিমেন্টাল ছবি তুলি, তাই ঘরেই এসব করা যায়) আর লেখালেখি (যেটা আমার ফেসবুক বন্ধুরা এখানে দেখতে পান) এসব করে দিব্যি দিনের পর দিন কেটে যায়, বোর হওয়ার সময় পাইনা। কিন্তু এখন ঠিক বোর নয়, তবে বিরক্ত হই। আমার তো টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি কিছুই নেই, আছে নিজের মত করে একটু কাজ করার স্বাধীনতা, পাশে বনে বা ভোলগার তীরে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা। সেটাও হারানোর পথে। এই যে আমরা সবাইকে ঘরে বসে থাকতে বলছি সেটা কি শুধু নিজের কথা চিন্তা করেই নয়? যে লোক সারা দিনের কাজের শেষে ঘরে ফেরে বাচ্চাদের মুখে দুটো অন্ন তুলে দিত তাকে করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে কি করে চলবে? ভাবুন তো পাখীর কথা! সে যদি ঝড় বাদলের মধ্যেও বাচ্চাদের জন্য খাবার সংগ্রহ না করে কি হবে তার আর তার বাচ্চাদের? ঘরে থাকা, কথাটা বলা সহজ, কিন্তু এ ঘরে থাকা শুধু ঘরে থাকায় নয়, জেলে বন্দী থাকা। আমাদের কয় জন জেলে থাকার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত? না, আমি কাউকে বলছি না ঘর ভেঙে বাইরে চলে যেতে, যা বলছি সেটা হল যদি কেউ বাইরে যায় আমরা যেন তার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নেওয়ার চেষ্টা করি। মানুষ সামাজিক জীব, তাকে অসামাজিক করা, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা যেন করোনার ভয়ে মরার আগেই মরে না যাই। তবে আমি যখন বাইরে যাই, আমি যেন কম বেশি নিশ্চিত হয়, আমার দ্বারা কেউ আক্রান্ত হবে না। ঘরেই থাকি আর বাইরেই যাই আমি যেন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করি। করোনাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাসের মত এখানেও ত্রাণ তহবিল থাকা দরকার। একজন প্রান্তিক মানুষকে করোনার হাত থেকে বাঁচাতে ছুটি দিয়ে তাকে যেন জীবন থেকে ছুটি না দেওয়া হয়। করোনা ভীতি, করোনা ছুটি, করোনা লক ডাউন - এসবের কারণে যারা মারা যাবে তাদের মৃত্যু যদি করোনা ভাইরাসে নাও হয় তবুও তারা হবে করোনা ভিকটিম। এ এক সার্বজনীন যুদ্ধ। সেখানে কিছু ভুল হবে, কিছু লোক মারা যাবে এ সবই সত্য। কিন্তু কেউ যেন অবহেলায় মারা না যায়, কেউ যেন কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালী আর বোকামীর জন্য মারা না যায়! মস্কো, ২৪ মার্চ ২০২০

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা