আমাদের করোনা

বন্ধুরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে রাশিয়ায় করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে। থেকে বুঝি বাইরে হয়তো রাশিয়া সম্পর্কে তেমন খবর পায় না, বা পেলেও হয়তো বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে না কারণে যে এখানে এখনও করোনা ভাইরাস ঠিক ততটা ছড়ায়নি যতটা ইতালী, স্পেন, জার্মানি বা অ্যামেরিকায়। এখানে যে অবস্থা ওদের চেয়ে ভালো হতে পারে সেটাই অবিশ্বাস্য। আমরা নিজেরাও যে সব খবর জানি তা নয়, যেটুকু পাই, সেটা অফিসিয়াল তথ্য। প্রতিদিন সংবাদে এসব বলে, একের পর এক টক শো হয় বিষয়ে। আজ খবরে বলল, এদেশের করোনা বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান হাসপাতাল কমুনারকার প্রধান ডাক্তার, যিনি মাত্র কয়েকদিন আগে পুতিনকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত রুগীদের দেখিয়েছেন, তিনি এখন করোনা পজিটিভ। তিনি নিজেই খবর দিয়েছেন, নিজেকে আইসলেট করেছেন এবং সেখান থেকেই রুগী কলিগদের যেটুকু সাহায্য করা যায় করছেন। থেকে মনে হয় প্রশাসন নিয়ে কোন লুকোচুরি খেলছে না। এতো দিন রুগিদের সংখ্যা বেড়েছে ধীর গতিতে। আজ একদিনে রুগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০০ আর মৃত্যু হয়েছে জনের। এই মুহূর্ত পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে ৫৩৬৬৬৯। করোনা পজিটিভ ২৩৩৭, সুস্থ হয়েছে ১২১, মারা গেছে  ১৭ জন।

গতকাল সংখ্যাটা অনেক কম ছিল। এক বন্ধু ফোন করেছিল অ্যামেরিকা থেকে। কথার এক পর্যায়ে বলল তোদের ওখানে টেস্ট কম হয়, তাই করোনা পজিটিভ মানুষের সংখ্যা এতো কম। ট্রাম্প সেটাই বলেন। এখানে তর্ক করার সুযোগ নেই। তবে দুটো কথা বলা দরকার।

প্রথমত হাজারো চাইলেও একটা দেশের সমস্ত মানুষকে টেস্ট করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আজ যে সুস্থ দু'দিন পরে সে অসুস্থ হবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই। তাই এভাবে এক নাগাড়ে টেস্ট করে গেলে সেটা খুব ভালো কিছু দেবে বলে মনে হয়না। ক্ষেত্রে বিভিন্ন জরিপের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে জরিপ করে সাধারণত টেলিফোনে আর নম্বরগুলো নেয় ্যান্ডম মানে অনুমানে। তাই এক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কম থাকে। আর সেসব উত্তরের ভিত্তিতে কোন কিছুর পূর্বাভাস দেয়। বলতে পারেন যদি সবাই এক মতের হয়? কারণেই ্যান্ডম নম্বরে ফোন করা আর যেকোনো ত্রুটি  এড়াতে যতদূর সম্ভব বেশি লোককে জিজ্ঞেস করা। থিওরেটিক্যালি সেই নম্বরটা হওয়া উচিৎ অসীম। কিন্তু আমাদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ। তাই আমরা চাইলেও অসংখ্য লোককে টেস্ট করতে পারব না, আর তার দরকারও নেই। আমাদের দরকার একটা কার্যোপযোগী মডেল তৈরি করা আর তার ভিত্তিতে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের রণনীতি রণকৌশল তৈরি করা। ব্যাপারে ছাত্রজীবনের একটা চুটকির কথা মনে পড়ল।

পদার্থবিদ্যা আর গণিতের ছাত্রদের মধ্যে সব সময়ই একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলে। আমাদের সময় ব্যতিক্রম ছিল না। সে নিয়েই এই চুটকি। একদিন এক লোক পদার্থবিদ্যা আর গণিতের দুই ছাত্রকে নিয়ে গেল প্রায় কুড়ি মিটার লম্বা এক ঘরের দরজায়। ঘরের অন্য প্রান্তে রাখা আছে এক পুরস্কার।  ছাত্রজীবনে, যখন জীবন নদীর দু'কুল উপচে পড়ত যৌবনের জল, ওখানে পুরস্কার হিসেবে থাকত অপার্থিব সুন্দরী এক মেয়ে (মেয়েদের ক্ষেত্রে অপূর্ব সুন্দর এক ছেলে) তখন আমরা ছিলাম বস্তুবাদে বিশ্বাসী আর এই বিশ্বাস ছিল ভাববাদী, মানে যতটা না বুঝে তার চেয়ে বেশি আবেগ তাড়িত। এখন পঞ্চাশের এপারে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে আমরা হয়েছি ভাববাদী, তার তাই যতটা না আদর্শ তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি বস্তুতে, মানে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদিতে। ভোগবাদী সমাজে এটা অবশ্য নিন্দনীয় নয়। তাছাড়া ছেলে বা মেয়ে যত অপার্থিব সুন্দরই হোক না কেন, পটেনশিয়ালি তারা করোনা ভাইরাসের ডোনার হতে পারে। তাই যাকে বলে «আত গ্রেখা পা দালশে» মানে «পাপ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে» আমরা পুরস্কার হিসেবে রাখব «কোহিনূর» দু' জনের মধ্যে যে আগে সেই হীরাটার কাছে যেতে পারবে, সেই হবে কোহিনূরের মালিক। তবে একটা শর্ত আছে। প্রতিবার তারা শুধু অর্ধেক পথ যেতে পারবে, মানে প্রথম বার ১০ মিটার, এরপর মিটার ইত্যাদি। গণিতের ছাত্র হিসেব করে দেখল এভাবে যেতে থাকলে কোহিনূরের কাছে সে জন্মেও পৌঁছুতে পারবে না। তাই সে প্রতিযোগিতায় নামতে রাজী হল না। পদার্থবিদ্যার ছাত্র দেখল কোহিনূর হস্তগত করতে তার মাত্র কয়েকটা ধাপই যথেষ্ট। এর মধ্যেই সে ওটাকে নেওয়ার মত দুরত্বে চলে আসবে। আসলে এখানেই থিওরি আর প্র্যাকটিসের মধ্যে পার্থক্য।

ফিরে আসি করোনার কথায়। সঠিক অবস্থা জানার জন্য তাই সবার টেস্ট করার দরকার নেই। দরকার আপেক্ষিক ভাবে একটি বড় সংখ্যার মানুষের টেস্ট নেওয়া। এক্ষেত্রে ভালো হয় যারা রিস্ক জোনে তাদের টেস্ট করা। এরা কারা? যারা করোনা আক্রান্ত এলাকায় বা দেশে ছিল তারা, দেশে  ফেরার পর যাদের সংস্পর্শে তারা এসেছে আর অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষ। একটা বয়সের পর মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়,  তাই অল্প বয়সী মানুষের চেয়ে তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকে। যেহেতু রিস্ক জোনে সবচেয়ে বেশি মানুষের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই এই টেস্টগুলো থেকে সমাজে সর্বোচ্চ কত মানুষ করোনা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে তার একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সরকার বা প্রশাসন প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল, বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি প্রস্তুত করতে পারে। মূল কথা প্রস্তুত থাকা আর অপেরেটিভ সাহায্য দান। এখনও পর্যন্ত টেস্টের অনুপাতে করোনা পজিটিভের হার খুব বেশি নয়, সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা মৃতের সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুন বেশি। এটা আশার কথা। তবে এতদিন যদি মূলত করোনা পজিটিভ ছিল বাইরে থেকে আসা মানুষ, এখন যারা বিগত কয়েক সপ্তাহে বাইরে যায়নি তারাও অসুস্থ হচ্ছে। ইতালীর পরে ধারনা করা হয়েছিল করোনা মূলত ষাটোর্ধ লোকদের আক্রমণ করে, ফলে সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও বিশেষ করে তরুন সমাজ গত শনি রবিবার রাস্তায় ব্যাপক ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে, বারবিকিউ আয়োজন করেছে। তরুন সমাজ বরাবরই ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলে। এছাড়া রাশিয়ায় সেই সেপ্টেম্বর থেকে সূর্যের দেখা প্রায় মিলেই না, ফলে ছুটির রৌদ্রজ্জ্বল উষ্ণ দিনে অনেকেই ঘরে বসে থাকতে পারেনি। তাই সরকারকে সোমবার থেকে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। এখন থেকে বিনা কারণে বাইরে গেলে জরিমানা করতে পারবে ১১  থেকে ৪০ হাজার রুবল পর্যন্ত, কোম্পানির জন্য সেটা হবে লাখ রুবল।  কারেন্টিন না নামায় কেউ যদি কারও মৃত্যুর কারণ হয় তাকে বছর পর্যন্ত জেল খাটতে হতে পারে। সারাদিন শুধু সরকার বা প্রশাসন নয়, জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, খেলোয়াড়রা সবাইকে ঘরে থাকতে বলছে। গতকাল পর্যন্ত শ্লোগান ছিল «সিদি দোমা» মানে «ঘরে বসে থাক» যেহেতু রুশ ভাষায় «সিদেচ» বলতে জেল খাটাও বোঝায় তাই আজ থেকে শ্লোগান হচ্ছে «ঝিভি দোমা» মানে ঘরে বাস কর, ঘরে বাঁচ।

এখনও প্রায় ১০ হাজার রাশিয়ান বাইরে। তারা বিভিন্ন দেশে আটকা পড়ে আছে। সরকার চেষ্টা করছে তাদের ফিরিয়ে আনতে। সবাই ফিরে আসলে করোনা পজিটিভের সংখ্যা বাড়বে সেটা ঠিক। এছাড়া লোকজন মস্কো বা বড় বড় শহর থেকে যখন নিজ এলাকায় ফিরবে তখন সেখানে রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। এখানে মধ্য এশিয়ার প্রচুর লোক কাজ করে, মূলত অড জব। এখন তারা শুধু কর্মহীন নয়, কপর্দকহীনও। রাস্তায় লোকজন কম, তাই এসব লোকজনের উৎপাত বাড়তে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে।

সরকার চেষ্টা করছে সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কতটুকু সফল হবে সেটা নির্ভর করছে সাধারণ মানুষ এখানে কতটা দায়িত্বপূর্ণ হবে। এটা অনেকটা মুক্তি সংগ্রামের মত। দেশের প্রতিটি নাগরিক যুদ্ধের সৈনিক। এর মধ্যে নিজেরা নিজেদের টেস্ট কীট তৈরি করেছে। কাজ চলছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের। অপ্টিমিস্টিক পূর্বাভাস, জুনের মধ্যেই দেশ করোনা মুক্ত হবে, পেসিমিস্টিক সেপ্টেম্বর। কাজকর্ম করছি ঘরে বসে, ক্লাস নিচ্ছি অন লাইনে। এসবই নতুন অভিজ্ঞতা। করোনার কারণে ইনস্টিটিউট, ভার্সিটি, দোকানপাট বন্ধ করা যায়, কিন্তু আমাদের মত মানুষ শরীরের রোগালয় শাট ডাউন করতে পারে না। বসন্তের সাথে সাথে ব্যথাগুলো ফিরে এসেছে। ফলে রেগুলার ইঞ্জেকশন নিতে আর ফিজিও থেরাপি দিতে ক্লিনিকে যেতে হয়। এটা অবশ্য জং পরা থেকে হাড্ডিকে রক্ষা করে। সব মিলিয়ে করোনা জীবন চলছে নিজের গতিতে।                   
    
    
দুবনা, ৩১ মার্চ ২০২০




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা