সেই সময় এই সময়

আশির দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায় সবাই, বিশেষ করে ছাত্রদের একাংশ হঠাৎ করেই বিজনেজ ম্যান হয়ে যায়। পেরেস্ত্রইকার ক্ষুধা পুরনে তারা সিঙ্গাপুর থেকে আনতে শুরু করে কম্পিউটার, তুরস্ক থেকে গার্মেন্টস, জ্যাকেট ইত্যাদি। পকেটে পয়সা থাকুক আর নাই থাকুক, পয়সাওয়ালা বন্ধুদের সাথে চলতে গেলে খরচ বেড়ে যায়। পরিণাম - ধারদেনা। সে সময় মস্কোর বাঙ্গালী সমাজে আমাকে পছন্দ না করা মানুষের অভাব ছিল না। তবে কিছু কিছু মানুষ আমাকে পছন্দও করত, যদিও তার কারণ আমি খুঁজে পাইনি। বউ বলে, যারা আমাকে পছন্দ করে তাদের জন্য আমি অনেকটা বলির পাঁঠা। এরা নিজেরা যদি জীবনে কিছু করতে না পারে আমার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয় যে তাদের চেয়েও ব্যর্থ মানুষ পৃথিবীতে আছে। আমি অবশ্য এনিয়ে কিছু মনে করি না। এভাবেও যদি কিছু মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়া যায়, ক্ষতি কি? আমি ছেলেমেয়েদের বলি পৃথিবীতে প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের বাস। এদের অনেকেই তোমাদের চেয়ে অনেক ভালো আছে আবার অসংখ্য মানুষ তোমাদের চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকে। তাই মন খারাপ করার কিছু নেই, আরেকটু ভালো থাকার লড়াই করতেই পার।

যাহোক যে কথা বলছিলাম, বন্ধুরা বলল আমার তুরস্ক গিয়ে কিছু জ্যাকেট এনে বিক্রি করা উচিৎ। তারাই করবে। আমাকে শুধু ওখানে গিয়ে জ্যাকেটগুলো কিনে আনতে হবে। এক কথায় সবাই মিলে আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিল। ইস্তাম্বুল গিয়ে ছবি তুলে আমার সময় কাটল, আর যখন মনে পড়ল কেন আমি এখানে এসেছি, তাড়াহুড়ো করে দামি দামি কিছু জ্যাকেট কিনে মস্কো ফিরলাম। আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। বংশ পরম্পরায় আমাদের ব্যবসা। তাই সিওর ছিলাম, আমি খুব ভালো জিনিস এনেছি। সব দেখে বন্ধুদের মুখ কালো। আমার নীট ক্ষতি ৯০০ ডলার। ১৯৯০ সালে সেটা আমার জন্য বড় অঙ্কের টাকা। সাথে সাথে সবাই এটাও বলল, আর কোনদিন যদি বিজনকে কোথাও পাঠানো হয় ওর কাছে থেকে ক্যামেরা কেঁড়ে নিতে হবে।

করোনা ভাইরাস আর যাইহোক স্বৈরাচারী একনায়ক নয়। তা না হলে নিজের আসার সাথে সাথে আর সব পুঁচকে রোগ বালাইকে ঝেটিয়ে বিদায় করত। করোনার এই দুর্বলতা আমাকে ক্ষুব্ধ করে। বসন্তে ভালবাসার সাথে সাথে হাজার রকম ব্যথা আমার ঘাড়ে চেপে বসে। করোনার গাফিলতিতে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই সকালে উঠেই যেতে হয় হাসপাতালে ইঞ্জেকশন নিতে। মোট চল্লিশটা। এরপরে পশ্চাদ্দেশের ব্যথায় কিনা জানি না, তবে ঘাড়ের ব্যথা কয়েক মাসের জন্য বিদায় নেয়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

এক বন্ধুর জন্য মস্কো থেকে কিছু কাগজ এনেছি। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে ফোন করে বললাম, মিনিট পনের পরে অমুক জায়গায় দেখা করে সেগুলো দেব। রাস্তা অবশ্য তেমন বেশি না। তবে ইদানীং কালে আমি ইন্টারেস্টিং কিছু দেখলে প্রায়ই স্মার্ট ফোন বের করে ছবি তুলি। তাতে অফিসে যেতে দেরি হয়, অনেক সময় ক্লাসে যেতে দেরি করি। ছাত্ররা অপেক্ষা করে। আমি সেই রমাশকভার রেল ইঞ্জিনের (паровозик из ромашково) মত, যে ভাবে যদি সে প্রথম ফুল না দেখে তাহলে সারা জীবনের জন্যই দেরি করে ফেলবে। যাহোক পনের মিনিটের রাস্তা লম্বা হয়ে কখন যে তিরিশ মিনিটের হয়ে গেল! ওকে বললাম, বুঝলি, রাস্তা কেন যেন লম্বা হয়ে গেল। ও হেসে বলল, বয়স, বুঝলি বয়স। আর আমার মনে পড়ে গেল সেই ১৯৯০ এর কথা। সেই ইস্তাম্বুল, বন্ধুদের হতাশা। এটাও করোনার পজিটিভ দিক, ফিরে তাকানোর সময় বের করে দেওয়া।

দুবনা, ২৭ মার্চ ২০২০ 
 
 
 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা