পথ

সমস্যাটা হল দৃষ্টিভঙ্গীর। আমি হাসপাতাল বানাবো না উপাসনালয় এই দুটো পথের মধ্যে যোজন দূরত্ব। হাসপাতাল বানানো মানে নিজেদের  সমস্যা নিজেরা সমাধান করার চেষ্টা করা, আর উপাসনালয় গড়ার অর্থ নিজেদের সমস্যার সমাধান অন্যদের, মানে ঈশ্বর বা দেবতাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। মা বলতেন "পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন।" শান্তির সময়ে, স্বাভাবিক সময়ে উপাসনালয় হয়তো বা আপনাকে মানসিক শান্তি দেয় যদিও বর্তমানে কিছু কিছু  উপাসনালয় শান্তির চেয়ে অশান্তি ছড়ায় বেশি। সেটা অবশ্য উপাসনালয়গুলোর দোষ নয়, দোষ আমাদের, আমরা যারা সেখানে যাই আর এটাকে মানুষে মানুষে বিভেদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করি। 

রাশিয়ায় বলে ব্ল্যাক ডে মানে মৃত্যুর দিনের জন্য প্রস্তুত থাকা। সবাই, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ তার শেষকৃত্যের জন্য কিছু টাকাপয়সা আলাদা করে জমিয়ে রাখে। ভালোমন্দ জানি না, তবে এটা মানুষকে খারাপ সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, তাকে খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত হতে শেখায়। হাসপাতাল - সেই খারাপ সময়ের অংশ এই অর্থে যে যেকোন দিন তোমার শরীর খারাপ হতে পারে, তখন উপাসনালয়ের চেয়ে হাসপাতাল অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। রাশিয়ায় বয়স্ক মানুষ হাসপাতালে যত নিয়মিত যায়, গীর্জায় ততটা যায় বলে মনে হয় না। 

আমরা কেন হাসপাতাল না গড়ে উপাসনালয় গড়ি? কারণ আমরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি না। আমরা জনগণের প্রতীক নই, ক্ষমতার প্রতীক। তাই জনগণের দেখভাল করার দায়দায়িত্ব উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিই। আর নিজেরা কখনও জনগণের হয়ে, কখনও বা উপরওয়ালার হয়ে ছড়ি ঘুরাই। এটা আসলে আমাদের দাসত্বের মানসিকতা। যত বড়ই হই, মানসিক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। ভূমিহীন কৃষক থেকে দেশপ্রধান পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করি কবে আকাশ থেকে আশীর্বাদের বৃষ্টি নেমে আসবে আর আমাদের শত অবহেলা, অযোগ্যতা সব ভুলে সবাইকে সব শোক দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। ভগবান বেচারি আর কি করবেন? তিনি তো জাদুকর নন। তাই মরণ ঘুমে সবাইকে বা অনেককে ঘুম পাড়িয়ে দেন। এভাবেই তিনি অভাগাদের মধ্যে শান্তি আনেন। তাতে সবাই লাভবান হয়। ভগবানের লোকাল এজেন্টরা এটাকে তাঁর অভিশাপ বলে চালিয়ে দেয়। দেশের যারা ভাগ্যবিধাতা তারাও পরবর্তীতে স্কুল কলেজ হাসপাতাল গড়ে মানুষকে স্বাবলম্বী হতে না শিখিয়ে নতুন নতুন উপাসনালয় গড়েন ভগবানকে খুশি করার জন্য। এভাবেই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। একদিকে ভগবান, আরেকদিকে সাধারণ মানুষ আর মাঝখানে ধর্মব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন দালাল যারা সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল রেখে খায় আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। 

মস্কো, ২৬ মার্চ ২০২০           


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা