ছোট ছোট কথা

কয়েক সপ্তাহ আগে ভোর পাঁচটার দিকে সেভার সাথে গেলাম মস্কো নদীর ধারে বেড়াতে। ও কমবেশি নিয়মিত যায়। আমি কালেভদ্রে যদি আবহাওয়া ভালো থাকে। কারণ আমি যতটা না ঘুরতে যাই তারচেয়ে বেশি যাই ছবি তুলতে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। হঠাৎ দু একটা গাড়ি বা রাতের বাস দেখা যায়। মস্কোর বাস সার্ভিস ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আর বাকি সময়টা থাকে রাতের বাস সার্ভিস যা মূলতঃ এয়ার পোর্ট ও রেল স্টেশনের সাথে সংযুক্ত। মাঝেমধ্যে দলবেঁধে তরুণ তরুণীরা সাঁ করে চলে যায় ইলেক্ট্রো বাইকে। ফুটপাতে ওদের জন্য লাইন মার্ক করা থাকলেও প্রায়ই পথচারীদের গা ঘেঁষে চলে যায়। দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে নিয়মিত ওদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। সেভা সকালে হাঁটতে বেরোয় মূলতঃ এসব ভীড় এড়ানোর জন্য।

দেবিল (মূর্খ, গাধা) - সেভা গজ গজ করে।
তুই এসব পছন্দ করলে এভাবেই যেতি। এটা বয়সের কারণে। ওরা কিন্তু তোর বয়সী।
তুমি সবসময় এসব এড়িয়ে যাও।
ঠিক তা নয়। তবে শত শত ভালোর মধ্যে দুই একটা খারাপ ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। আর বিশাল সাদা ক্যানভাসে কালো দাগ যেমন চোখে পড়ে, বিশাল কালো ক্যানভাসে সাদা দাগ তেমনি চোখে পড়ে। আমরা কনট্রাস্ট দেখি। যদি এই ছেলেমেয়েদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়াই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় তার মানে আমরা খুব খারাপ নেই।

আসলে আমরা প্রায়ই নিজেদের ছোটখাটো সাফল্যগুলো দেখতে পাই না, বড় বড় ঘটনাই আমাদের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করে। একই ভাবে বড় সাফল্যের কাছে ছোট ছোট ব্যর্থতা হারিয়ে যায়। তবে বিন্দু বিন্দু জল যেমন সাগর তৈরি করে ছোট ছোট সাফল্য তেমনি আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে ঠিক যেমন ছোট ছোট ব্যর্থতা আমাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সময় মত ছোট ছোট ব্যর্থতার দিকে দৃষ্টি না দিলে সেসব এক সময় ফাটাল আকার ধারণ করতে পারে। আর এজন্যেই দরকার নিয়মিত আত্মসমালোচনা।

কেন এই আলোচনা? গতকাল ছিল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এই উপলক্ষ্যে একটা অনলাইন আলোচনার আয়োজন করেছিলাম আমরা কয়েকজন। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা উঠল। আমরা প্রায়ই নতুন প্রজন্মের দোষ দেই তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না বলে। কিন্তু বিগত ৫৩ বছরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোই কি নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন বয়ান তৈরি করে তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস বিমুখ করেনি? অনেকেই বলে বাংলাদেশ আজ একাত্তর পূর্ববর্তী বাস্তবতায় ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা তো একদিনে হয়নি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই কি তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে দেশকে সেখানে নিয়ে যায়নি? এই ব্যর্থতা সব রাজনৈতিক দলের। দেশের সাধারণ মানুষ ভাত কাপড় চায়, চাকরি চায়, সামর্থ্যের মধ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা চায়। আপনারা যখন ক্ষমতার লড়াইয়ে মত্ত তারা ব্যস্ত জীবন সংগ্রামে।

বেকারের চাকরি, কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকের ন্যায্য পারিশ্রমিক, সব ধর্মের মানুষের জন্য নিরাপদে উপাসনা করার আর যারা বিশ্বাসী নয় তাদের অবিশ্বাস করার অধিকার নিশ্চিত করুন, দেখবেন কেউ আপনার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সাধারণ মানুষের কাছে আদর্শের চেয়েও ভাতের প্রয়োজন বেশি। ক্ষুধা জাত পাত মানে না। আর একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মত বুদ্ধিজীবী তৈরি করতে চাইলে মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিন। বড় বড় কথা আর তা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখার চেয়ে ছোট ছোট কাজগুলো সফল ভাবে করুন দেখবেন এসব একদিন সাফল্যের পাহাড় গড়ে তুলবে।

মস্কোর পথে, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

Comments

Popular posts from this blog

রিসেটের ক্ষুদ্র ঋণ

পরিমল

প্রশ্ন