২৪ জুনের দিনলিপি

শুক্রবার রাতে রুশ টিভিতে সেরকম কোন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম থাকে না আন্তর্জাতিক রিভিউ ছাড়া। তাই একটা প্রোগ্রামের ফাইনাল দেখে নিউজ চ্যানেল ঘোরালাম। রাত প্রায় দু'টো। ভাগনারদের প্রতি সুরাভিকিনের আবেদন। তবে খুব বেশি কিছু এ নিয়ে জানা গেল না। তাছাড়া ঘুম পেয়ে গেছিল। সকালে উঠে দেখলাম জনগণের প্রতি পুতিনের আহ্বান। ভাগনারের চ্যানেল আমি মাঝেমধ্যে দেখতাম, তবে খবরের চেয়ে অভিযোগ অনুযোগ আর নিজেদের বড় করে দেখানোর প্রবণতা থাকায় তেমন গুরুত্ব দেই নি। তখন থেকেই জানি বর্তমান সামরিক নেতৃত্বের প্রতি গ্রুপ প্রধান প্রিগঝিনের অবিশ্বাস, এদের ধীরে চলার নীতির বিরোধিতা। এর আগেও একাধিকবার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। এক কথায় ভাগনারের প্রধান প্রিগোঝিন, যিনি নিজে বিলিওনিয়ার, যে অন্যদের নেতৃত্বে সহজে মেনে নিতে পারবেন না সেটা তার সফল বায়োগ্রাফি বলে দেয়। ভাগনার গ্রুপ এর আগে সিরিয়া ও আফ্রিকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে, বিশেষ করে বাখমুত বা আর্তিওমভস্ক দখলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মে মাসের শুরুতে তারা বাখমুত ছেড়ে চলে যাবার কথা ঘোষণা করে। বিগত মাস দেড়েক তারা আর লাইম লাইটে নেই। হয়তো এটাও প্রিগোঝিনকে প্রভোক করেছে। গতকাল রুশ আর্মি তাদের ঘাঁটিতে হামলা করেছে বলে অভিযোগ করে টেলিগ্রাম চ্যানেলে খবর প্রকাশ করে। যুদ্ধের সময়ে এ ধরণের খবর প্রকাশ আইনত দ্বন্দ্বনীয়। আর্মি সেটা অস্বীকার করে। পরবর্তীতে প্রিগঝিন শইগু ও গেরাসিমভকে গ্রেফতার করার জন্য কোর্টে আবেদন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রিগঝিনের এ ধরণের ব্যবহার নতুন নয়। এর আগে পুতিনের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এসব মেটাতে হয়েছে। প্রিগঝিনের ভিডিও প্রচারের পরে ভাগনারের সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র ট্যাঙ্ক নিয়ে রোস্তভে আসে ও সেখানকার প্রাশাসনিক ভবন ও রোস্তভে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের আর্মির হেড অফিস ঘেরাও করে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রশ্ন করে তোমরা এখানে কি চাও, যদি দেশপ্রেমিক হও জুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাও। এটা দেখে আমার মনে পড়ল ১৯৯১ সালের কথা যখন আমি নিজে এক সেনাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম।

একটা কথা ঠিক যে প্রিগঝিন হিসেবি মানুষ। কেন এমন করলেন এ প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বর্তমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনি বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখেন। হয়তো বা এই সব অনুসারীর সংখ্যা তাঁকে এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে। হতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কোন টোপ। অথবা হতে পারে তিনি এর মাধ্যমে নিজের প্রতি দ্রিশ্তি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরের মত সেটাকে এড়িয়ে না গিয়ে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব ও প্রেসিডেন্ট এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সিদ্ধান্ত নেন। তবে যাই হোক না কেন এটা যে রাশিয়ার ভবিষ্যতে বড় দাগ রাখবে তাতে সন্দেহ নেই। হাজার বছরের ইতিহাসে রাশিয়া প্রায় কখনই বাইরের শক্তির কাছে পরাজিত হয়নি। এদের পরাজয় ঘটেছে আভ্যন্তরীণ অনৈক্যের কারণে। এতদিন পর্যন্ত সমাজে সেই ঐক্য ছিল। এখন কি দাঁড়াবে সেটা দেখার বিষয়। তবে ঘটনা যে সিরিয়াস তাতে সন্দেহ নেই। পুতিন বিদ্রোহীদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেছেন মস্কো সহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস বিরোধী আইন জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মাস প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে। সোমবার মস্কোয় সরকারি ছুটি। বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তবে আর্মিতে প্রিগঝনের সমর্থন আছে বলে মনে হয় না।

রাশিয়া এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধে আবাসিক এলাকা আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছে। ভাগনারের সেনাদের বড় অংশই জেল খাটা আসামীদের দ্বারা গঠিত, তাই তাদের কি করবে সেটা দেখার বিষয়। রোস্তভে তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। তাই সেখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু। শোনা যাচ্ছে তারা ধীরে ধীরে মস্কোর দিকে এগুচ্ছে। ফলে মস্কো যাবার পথে বেশ কড়াকড়ি। মস্কোর প্রবেশ পথে সাজোয়া গাড়ি বসাচ্ছে বলে শুনলাম। তবে ইতিমধ্যে রাশিয়ার সমস্ত প্রদেশের প্রধানগণ সেনাবাহিনী ও প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছেন, তারা নিজ নিজ এলাকার ভাগনার গ্রপের সদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাবার ডাক দিয়েছেন। কাদিরভ বাহিনী রোস্তভের কাছে পৌঁছে গেছে যদি ভাগ্নার বাহিনীকে বাঁধা দিতে হয়। আলক্সান্দর লুকাশেঙ্কো ঘোষণা করেছেন যে প্রিগঝনের সাথে তার কথা হয়েছে। তারা একমত হয়েছেন যে কোন মতেই রাশিয়ার মাটিতে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। এখন নেগোসিয়েশন চলছে যাতে প্রিগঝিন সহ ভাগনারের সদস্যরা এই অব্বস্থা থেকে নিরাপদ ভাবে বেরিয়ে আসতে পারে। সেটাই হবে সব চেয়ে ভালো আউটকাম।

প্রিগঝিন তার ভিডিও বার্তায় যেসব অভিযোগ তুলেছেন সেটা মূলত পশ্চিমা মাধ্যমের ভার্সনের প্রতিধ্বনি। তাই সেটা নিঃসন্দেহে রাশিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ করবে। গত দেড় বছরে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে পেরেছিল। সেটা হয়তো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাছাড়া ন্যাটোর ভিতরেও ইউক্রেনের ভাগ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। বর্তমান ঘটনা তাদের নতুন করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।

তবে জনজীবন কমবেশি আগের মতই আছে। টেলিগ্রাম চ্যানেলে রোস্তভ সহ বিভিন্ন শহরের যে ছবি তাতে জীবন কমবেশি আগের মতই, যদিও বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে চলাফেরা একটু ব্যাহত হচ্ছে। একই কথা বলা যায় মস্কো বা অন্যান্য শহর সম্পর্কে। পিটারে ভাগনারের হেড অফিসে তল্লাশি চালানো হয়েছে। দুবনায় লোকজন চলছে, ফিরছে, ঘরাফেরা করছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এক কথায় সূর্য আগের মতই পুব্দিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত গেছে। আবহাওয়া ভালো। ১৯ ডিগ্রি। ভোলগায় নামা হয়নি মেঘের বিশ্বাসঘাতকতায়।

দুবনা, ২৪ জুন ২০২৩


 

Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

স্মৃতি