ভাবনা

 

বিদেশে খুব কম লোকই বাংলা সহিত্য পড়ে, বাংলায় যারা লেখে তাদের কথা জানে। এমনকি সাহিত্যিক মহলেও রবীন্দ্রনাথের বাইরে আর কেউ তেমন একটা পরিচিত নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত হয়তো কারণেই ইংরেজি দিয়েই শুরু করেছিলেন। এখনও ভারতীয় উপমহাদেশে যারাই বিশ্ব সাহিত্যে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন সবাই ইংরেজিতে লেখেন তা তিনি সালমান রুশদি হোন, অরুন্ধুতী রায় হোন আর যেই হোন। এমনকি ইংরেজিতে অনুবাদ না হলে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেতেন কিনা বা তাঁর কথাও কেউ জানত কিনা সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা ইংরেজি সাহিত্যের কথা জানি ইংরেজি পড়তে পারি বলে। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ, রুশ বা অন্যান্য ভাষার লেখকদের জানি অনুবাদের সুবাদে। আর অনুবাদ হয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা। তাছাড়া ইউরোপ আমেরিকার মানুষের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যগত ঐতিহাসিক মিল থাকায় তারা একে অন্যকে সহজেই বুঝতে পারে, ফ্রান্সের পাঠক ইংরেজ বা জার্মান বা স্প্যানিস লেখকের লেখার সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনায়াসে হাঁটতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপট ওদের কাছে অধরাই থেকে যায়। আমাদের লেখা ভারতে পাঠকের কাছে যতটা বোধগম্য বাইরে ততটা নয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্য কি হিন্দি, উর্দু বা অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়? উল্টোটাও তো হয় না। আসলে আমরা সব সময় পশ্চিমা স্বীকৃতি পেতে চাই। এখানেই কি সব সমস্যার মূল নিহিত নয়? আজ বিশ্ব যখন এই এককেন্দ্রীক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া তখন সময় এসেছে সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই নতুন করে ভাবার, নতুন করে দেখার। ইউরোপের মানুষ যতই বাহবা দিক না কেন ভারতীয় ক্ল্যাসিকাল মিউজিক যেমন তাদের অধিকাংশের কাছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, সাহিত্যও তাই। বাংলার লোকসংগীত বাংলার বা ভারতের মানুষ যতটা বুঝতে, যতটা অনুভব করবে ইউরোপের মানুষ সেটা পারবে না। তাই মনে হয় সময় এসেছে নতুন করে সব কিছু ভেবে দেখার, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার। তবে একই সাথে আমাদের এটাও ভাবতে হবে কিভাবে আমাদের সহিত্য আমরা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে পারি। সোভিয়েত আমলে, যখন পুঁজিবাদ সম্পর্কে এদের প্রচণ্ড এলারজি ছিল তখনও কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার লেখকদের লেখা এখানে অনূদিত হত। টমাস মান, হেরমান হেসে, এরিখ মারিয়া রেমার্ক , আন্দ্রে জিদ, জুল ভার্ণ, ভিক্টর হুগো, মোপাশা, শেক্সপীয়ার, হেমিংওয়ে, ফকনার কাদের বই এখানে অনূদিত হয়নি? আর সেটা করেছে সরকারি পয়সায় নাম করা সব কবি সাহিত্যিকরা। রবীন্দ্রনাথ, রামায়ণ, মহাভারত সহ ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বইয়ের অনুবাদ ছিল। আর এরা তো নিজেদের বই অনুবাদ করে বিভিন্ন দেশে পাঠাত। প্রগতি আর রাদুগার বইয়ের কথা কার না মনে আছে। আর এসব অনুবাদ করতেন বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকগণ। রাশিয়ায় অনেকেই রবীন্দ্র চর্চা করেন। আমাদের দেশেও বিদেশী অনেক লেখকদের নিয়ে চর্চা করা হয়। কিন্তু অন্যতম জনপ্রিয় কবি হবার পরেও জীবনানন্দকে নিয়ে তেমন চর্চা হয় কি? তার কাজের উপর গবেষণামূলক লেখা হয় কি? তাই আমরা যদি আমাদের কথা, আমাদের সাহিত্যের কথা অন্যদের জানাতে চাই নিজেদেরই সেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে গবেষণা করতে হবে, বিদেশী কবি সাহিত্যিকদের দ্বারা আমাদের বইয়ের অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ শখের অনুবাদ প্রায়ই মানসম্মত হয় না আর সেসব লেখা পড়ে বিদেশীদের আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে ভাল কোন ধারণা গড়ে ওঠে না।    

 

দুবনা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা