মায়া


বাবা প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় আহ্নিক করতেন। তাঁর অন্য কোন ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না, পূজা পার্বণে অংশ নিতেন না বললেই চলে, তবে এই আহ্নিক, সাথে গীতা বা চণ্ডী পাঠ আর মালা জপা। মালার ব্যাপারটা ছিল একই সাথে হাঁটা, মানে উনি হাঁটতে হাঁটতে এটা করতেন, ফলে ধর্মের কিছু না হলেও শরীরের জন্য উপকারী ছিল। তবে কথাটা বাবাকে নিয়ে নয়।

আমি ছোটবেলায় মাঝেমধ্যে বাবার সেই চণ্ডী পড়তে পছন্দ করতাম। সেখানেই সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাই। পরে নিজে যখন কসমোলজির উপর কাজ করতে শুরু করি তখন দেখি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত অনেক ফলাফল বা বলা যায় মহাবিশ্বের মডেল প্রতীকী ভাবে হলেও চণ্ডীর সেই গল্পের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এ নিয়ে অবশ্য "আকাশ ভরা সূর্য তারাঃ কসমোলজির সেকাল একাল" বইয়ে আলোচনা করেছি। যাহোক চণ্ডীর শুরুটা ছিল এমন - রাজা সুরথ ও বৈশ্য সামন্ত এসে হাজির হয় মেধা মুনির আশ্রমে। তারা পরিবারের অন্যদের ষড়যন্ত্রে সর্বস্ব খুইয়ে বনে এসে মনে দুঃখে দিন কাটাচ্ছে। এই যে পরিবারের লোকেরা ওদের প্রতি এত অন্যায় করল তারপরেও কিছুতেই তাদের ভুলতে পারছে না, তাদের জন্য মন খারাপ করছে, তাদের দেখতে মন চাইছে। ওদের সব কথা শুনে মেধা মুনি বলেন "এ সবই মায়া। তোমরা যাদের নিজের মনে করছ তারা আসলে কেউ তোমাদের নয়।" মায়া অবশ্য বাংলা ভাষায় দুটো অর্থে ব্যবহৃত হয় - একটা মমতা বা এফেকশন, অন্যটা অলীক বা ইল্যুশন। মেধা মুনি ইল্যুশন অর্থেই মায়া শব্দ ব্যবহার করছিলেন যদিও সারথি আর সমন্তের জন্য এসব ছিল মমতা বা এফেকশন।

বছর দুয়েক আগে গভীর রাতে মস্কো থেকে ফেরার সময় আমার স্ত্রী রাস্তায় কিসের একটা সুবাস পায়। যদিও ট্রেন আসে রাত বারোটার দিকে আর বাসা থেকে স্টেশন প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তা - আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা হেঁটেই বাসায় ফিরি, অন্তত আমি। যাহোক ও বাসায় ফিরে যখন এটা বলল, পরের দিন আমাদের অভিযান শুরু হল গন্ধের উৎস সন্ধানে। দেখলাম বাসা থেকে কিছুটা দূরে সাদা অতসী ফুটে আছে। ওখান থেকেই এই গন্ধ আসছে। এর আগে দুবনায় সাদা অতসী দেখিনি, শুধুই হলুদ। এর পরে অবশ্য আরও অনেক জায়গায় ওদের দেখা পেয়েছি। যাহোক, তখনই সিদ্ধান্ত নিই বাসার কাছে কোথাও ওদের লাগানোর। গত বছর কিছু বীজ সংগ্রহ করি। আমি এসব বাসার আশেপাশে আর ভোলগার তীরে ছড়িয়ে দিই। গুলিয়া বাসায় লাগায়। সেখান থেকে জন্মে গাছের চাড়া আর আমি ওসব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে দিই। এখন কারণে অকারণে ওদিকে যাই শুধুই দেখার জন্য অতসী গাছ গুলো বাড়ছে কিনা। সেদিন একটা গাছকে দেখতে গিয়ে মনে হল আমিও বোধ হয় মায়ায় জড়িয়ে গেলাম।

দুবনা, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা