পুরানো নববর্ষ ও কিছু প্রশ্ন

আজ পুরানো নববর্ষ। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। এ উপলক্ষ্যে গতরাতে রুশ টিভি চ্যানেলগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমরা দেখলাম রাশিয়া -১ এ গলুবই আগানিয়ক বা নীল আলো। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল এই প্রোগ্রাম। নতুন রাশিয়ায় এই নামে প্রোগ্রাম হলেও আগের সেই আমেজ আর ছিল না। পশ্চিমা হাঙ্গর সংস্কৃতির খপ্পরে পড়ে যতটা না সংস্কৃতি তারচেয়ে বেশি অপসংস্কৃতির প্রচার হত বেশি কী গানে, কী পোশাকে, কী কৌতুকে। জৌলুশ ছিল, প্রাণ ছিল না, বিশেষ করে রুস্কায়া দুশা।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শুরু করার পরে পশ্চিমপন্থী যারা বিশেষ করে এত দিন রুশ মঞ্চের একচ্ছত্র অধিপতি ছিল তাদের এক বিরাট অংশ দেশত্যাগ করে। ফলে ধীরে ধীরে মঞ্চে ফিরে আসে সোভিয়েত ও রুশ দেশপ্রেমিক ধারার শিল্পীরা। আসলে ফেব্রুয়ারি থেকেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু নীল আলো মনে হয় সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। নতুন করে পুরানো গান, কবিতা ফিরে এসেছে। মনে হচ্ছিল আমরা যেন আবার আশির দশকের এটমোস্ফেয়ারে চলে গেছি।

দেখি গুলিয়ার চোখে জল। 

"পেরেস্ত্রোইকা আমাদের জেনারেশনের সব স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যৎ চুরি করে নিয়েছে, ধ্বংস করেছে আমাদের জেনারেশনকে। হয়তো অনেক কিছুই পেয়েছি তবে তার মূল্য পাওয়াটা ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় দেশে ৩০ মিলিয়ন লোক মারা গেছে। কোন পরিবার ছিল না যারা কাউকে হারায়নি। নব্বইয়ের দশকে নতুন করে সেটা ঘটেছে। কাজের আর অর্থের অভাবে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত ছেলেমেয়ে যে নেশা করে বা আত্মহত্যা করে হারিয়ে গেছে। গত কয়েক বছর দেশ ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও মানুষ ভোগবাদের ভোগান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিল না। যুদ্ধ একটা ধাক্কা দিয়েছে। এখন যদি না পারি আমরা আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। হয়তোবা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ফিরে আসবে হারানো সময়, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, হারিয়ে যাওয়া দেশ।"

আমি চুপচাপ শুনলাম। 

কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধুর সাথে যখন ক্লাব থেকে ফিরছিলাম ও বলছিল, 
"ভাবিস না। কয়েক মাসের মধ্যেই রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হবে। সব ব্র্যান্ড ফিরে আসবে।"

ওর কথারও কোন উত্তর দেইনি। ভেবেছি শিক্ষিত, সফল মানুষ, অনেক পড়াশুনা করে অথচ বোঝে না যে পরাজিত জাতি বা পরাজিত মানুষকে আজীবন মাথা নীচু করে থাকতে হয়। বিজয়ীরা দেখে না পরাজিত জাতির কে দেশের পরাজয়ে খুশি আর কে নয়। পরাজিত জাতির সবাই হয় শত্রু না হয় বিশ্বাসঘাতক।

সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক ভালোর মধ্যে বেশ কিছু খারাপ দিক আমি দেখেছি। তাই এখনকার ভালো দিকগুলো স্বীকার না করে শুধু খারাপ দিকগুলো সামনে আনা ভুল। তবে মানুষের সাইকোলজি এমন যে সে ভাবে সমাজে পরিবর্তন এলে শুধু খারাপ দিকগুলো উধাও হবে আর ভালোটা থেকে যাবে। কারণ তাকে তো কেউ তাড়াতে চাইছে না। অনেকেই চিন্তা করতে পারে না যে সমাজের ভালো মন্দ সব সমাজ ব্যবস্থা, তার রাজনীতি, অর্থনৈতিক বন্ধনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, একে অন্যের পরিপূরক। আসল কথা অনুপাতে। ১৯৯১ সালে এদেশের মানুষ ভেবেছিল নতুন ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের সব ভালো দিকগুলো থাকবে আর সাথে থাকবে জিন্স, দোকানে সব কিছুর প্রাচুর্য আর স্বাধীনতা। আমরাও আমাদের দেশে সেটাই ভেবেছিলাম। অনেক কিছু পেয়েছি তবে হারিয়েছি অনেক, বিশেষ করে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশ্নে। নতুন পরিস্থিতি শুধু স্বপ্নই দেখায় না নতুন প্রশ্নেরও জন্ম দেয়।

শুভ নববর্ষ।

দুবনা, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা