নকল নকল

কয়েক দিন ধরে ফেসবুকে সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ে নকল নিয়ে তান্ডব বয়ে যাচ্ছে। যতদূর বুঝলাম তাতে সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞানের পাঠ্য পুস্তকে দু'টো প্যারাগ্রাফ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি (অন্য কিছুও হতে পারে, তবে রেসপেক্টেবল প্রকাশনা) থেকে হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে। আর তাই নিয়ে এই লঙ্কা কাণ্ড। তবে অধিকাংশ লেখা পড়ে মনে হয়েছে মানুষ বকার জন্য বকেছে বা সুযোগ পেয়ে বকেছে। এই ঘটনা কতটুকু ক্ষতিকর বা আদৌ ক্ষতিকর কি না সেটা নিয়ে আলোচনা নেই বললেই চলে। ভুল করা অন্যায়, তবে ভুলের সমালোচনা করার সময় যদি সেই ভুলের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা না থাকে বা সেটা নিয়ে ভাবার ইচ্ছে না থাকে তাহলে সমালোচনা তার মূল উদ্দেশ্য হারায় যদি না উদ্দেশ্য হয় সুযোগ পেয়ে এক হাত নেয়া। কারণ সমালোচনার মূল লক্ষ্য ভুল সংশোধন। তবে অনেক সময় ভুল আশাতীত ফল বয়ে আনে। এরকম ঘটনা অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারে সাহায্য করেছে।

আমি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র, গবেষণা করি, পড়াই। নিয়মিত গবেষণা পত্র লিখি। তাই কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা আছে। আমি অবশ্য শুধু পদার্থবিজ্ঞানের কথা বলতে পারব। এখন বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা এতটাই সুদূর বিস্তৃত যে অধিকাংশ গবেষক কোন এক বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করেন আর এ বিষয়ে একাধিক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। প্রায় প্রতিটি নতুন কাজ হয় পুরানো কাজের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন সংযোজন। অনেকটা দালানে নতুন নতুন তলা তোলার মত আর দালান কত উঁচু করা যাবে সেটা নির্ভর করে ভিত্তির উপর। যেহেতু প্রত্যেক গবেষক চায় তার লেখা যতদূর সম্ভব নিখুঁত ও বোধগম্য করতে, তাই প্রতিটি নতুন সংযোজনে লেখককে ভাষাগত সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ পদার্থবিজ্ঞান সাহিত্য নয়। তার স্টেটমেন্টস হতে হবে আইনের মত। বর্তমানে এমনকি কেউ যদি নিজের কাজের ৩০% এর বেশি রিপিট করে সেটাকে নকল বলে গণ্য করা হয়। নকল বিরোধী টেস্ট হয় কম্পিউটারের সাহায্যে যে শুধু বাক্যের গঠনের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসে। সমস্যা হোল নিউটনের সূত্র যা সমস্ত টেক্সটবুকে যেভাবে লেখা আছে তারচেয়ে সংক্ষেপে, প্রাঞ্জল ও বোধগম্য করে লেখা প্রায় অসম্ভব। এটা প্রায় সমস্ত সূত্রের ক্ষেত্রেই বলা যায়। তাছাড়া মনে রাখতে হবে টেক্সট বুক লেখা মৌলিক গবেষণা নয়। মৌলিক গবেষণা পত্রে নকল করা নিন্দনীয় শুধু নয়, অবৈধ। বর্তমানে যেকোন জার্নালে পেপার সাবমিট করার সময় লেখককে এ ব্যাপারে লিখিত নিশ্চয়তা দিতে হয়। মৌলিক গবেষণা আর টেক্সট বুক লেখা দুটি আলাদা ব্যাপার। মৌলিক গবেষণা হল পুরানো তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে নতুন তত্ত্ব উপস্থাপন - সেটা হতে পারে পুরানো তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করা অথবা তার সংযোজন বা সংশোধন করা। টেক্সট বুকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ভাষায় শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা হয় যাতে একদিকে যেমন সেটা শিক্ষার্থীদের বোধগম্য হয়, অন্য দিকে তত্ত্বের মূল বাণী বিকৃত না হয়। গবেষণা পত্র আর টেক্সট বুকের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য এক - প্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করা। কিন্তু তাদের স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য ভিন্ন। তাই নকলের বিষয়টা দু’ ক্ষেত্রে দু’ রকম। কয়েক বছর আগে নিজে কসমোলজির উপর একটা বই লিখতে গিয়ে দেখেছি সেটা কত কঠিন। কারণ স্বল্প কথায় সঠিক ভাবে কোন কিছু, বিশেষ করে পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় প্রকাশ করা খুব কঠিন, বিশেষ করে বাংলা ভাষায় যখন টেরমিনোলোজি নিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি কেউ যখন পেপার লেখা শেষ করে তখন কাজের ফলাফল সংক্ষিপ্ত আকারে কয়েক লাইনে লিখতে হয়। এবং অনেক সময় দেখা যায় কাজটা তত সহজ নয় যত সহজ মনে হয়। আমরা যখন মুখে কিছু বলি সেটা বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে বা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি। সেটাকে যখন কাগজে লিখতে হয় তখন অনেক কিছুই ভাবতে হয়। কারণ মুখ থেকে ফস্কে যা বেরিয়ে যেতে পারে, কাগজে সেটা করা যায় না, করলে সেটাকে কেউ হালকা ভাবে নেয় না। এটা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কোন কিছু বোঝা আর বোঝানোর মধ্যে বিশাল ব্যবধান, বিশেষ করে সেটা যদি লিখে বোঝাতে হয়। কারণ বলার সময় শ্রোতা সামনে উপস্থিত, না বুঝলে প্রশ্ন করতে পারে, আপনার সুযোগ থাকে দ্বিতীয় বার বোঝানোর। যেটা লেখা হয় সেটা পাঠক আপনার অনুপস্থিতিতে পড়ে, তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। তাই লেখার ক্ষেত্রে আপনার দায় দায়িত্ব আরও বেশি।

প্রশ্ন উঠেছে অধ্যাপক জাফর ইকবাল কীভাবে এই নকল এড়িয়ে গেলেন? আমার ধারণা যদি প্যারাগ্রাফ দুটো কোন রেসপেক্টেভল জার্নাল থেকে নেয়া হয় তাহলে সেখানে তত্ত্বগত দিক থেকে কোন ভুল ছিল না আর একজন পদার্থবিদ হিসেবে অধ্যাপক ইকবাল সেটাই দেখেছেন। নকল ধরার জন্য তিনি সেখানে নিয়োজিত হননি। যদি লেখক উৎস রেফার করতেন তাহলে হয়তো সমস্যা থাকত না, তবে স্কুলের বইয়ে হয়তো সেই প্র্যাকটিস নেই। যারা টেক্সট বুক নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক তুলছেন তাদের উচিত বইয়ে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য কতটুকু সঠিক ও সহজবোধ্য ভাষায় শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে সেটা দেখা। নকল নিয়ে কথা উঠতেই পারে, তবে এই ক্ষেত্রে সেটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ সঠিক ভাবে শিক্ষা দেয়া। নকল একজনের ভুল কিন্তু নকল হতে পারে সেই ভয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা টেক্সট বুক লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের ভুল শেখাতে ও বোঝাতে পারে। অন্ধভাবে কারও বিরোধিতা করলে সেটা শেষ পর্যন্ত নিজের পায়ে কুড়ুলের আঘাত হানতে পারে।

দুবনা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা