অসহিষ্ণু সময়


আমাদের দেশে অনেক নেতাই যেকোনো দুর্ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের কোয়ান্টাম বাস্তবতায় সবই ডিস্ক্রেট বা বিচ্ছিন্ন। জীবন কিন্তু তা নয়, সেখানে সব ঘটনা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। তাই এড়িয়ে যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না।

স্যাটানিক ভার্সেস লেখার পর যখন সালমান রুশদির মস্তকের জন্য তিন মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয় সেই পৃথিবীতে এটা অকল্পনীয় না হলেও ছিল বিরল ঘটনা। এরপর থেকে সভ্যতা যতই অগ্রসর ও সহজলভ্য হচ্ছে আরও বেশি বেশি লেখক নিষিদ্ধ হচ্ছেন, হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন, নিষিদ্ধ হচ্ছে পুরো দেশ, পুরো জাতি। কারণ একটাই - নিজের বিশ্বাসের কাছে অন্ধ আত্মসমর্পণ, পরমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা।

যে অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে তথাকথিত সিভিলাইজড ওয়ার্ল্ড একসময় লড়াই করেছে আজ তারাই বিভিন্ন ধরণের অন্ধবিশ্বাস দ্বারা আক্রান্ত। কেন? আসলে যখনই কেউ নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে তখন ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক তাকে নিজের বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ হতে হয়। সেটা না হলে গনিতের ভাষায় যাকে বলা যায় -

সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে অথবা জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে এক সময় এমন এক সভ্যতার দেখা আমরা পাব যা বর্তমান সভ্যতার চেয়ে উন্নততর। অর্থাৎ যখনই আমরা অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসব তখনই আমাদের অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে হলেও উন্নততর সভ্যতার উপস্থিতির কথা স্বীকার করতে হবে। আর এর মানে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব পরিত্যাগ করতে হবে।

দীর্ঘ দিন যাবৎ একচ্ছত্র ভাবে রাজ্যত্ব করার পর পশ্চিমা সংস্কৃতি আজ দ্বিধাগ্রস্থ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক কিছু অফার করতে পারলেও সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে সে আজ দিশেহারা। স্বাধীনতা প্রায়ই স্বেচ্ছাচারিতা আর অরাজকতায় রুপান্তরিত হচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে কোন বিচ্ছিন্ন কারণে নয়, পুঁজিবাদী সমাজের অনিবার্য বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। তাই সালমান রুশদির উপর আক্রমণের প্রতিবাদ করার সাথে সাথে আমাদের বর্তমান সর্বগ্রাসী অসহিষ্ণুতার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে, তাকে না বলতে হবে। আর সেটা করতে হবে নিজের ভেতর যে সহিষ্ণুতার অভাব সেটার চিকিৎসার মধ্য দিয়ে। আমরা একদিকে সারা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়াব আর অন্য দিকে সবার কাছ থেকে সহিষ্ণুতা আশা করব - এটা হয় না। সালমান রুশদি শুধু স্যাটানিক ভার্সেস লিখেননি (এবং সেটা ধর্ম বিরোধী কিনা সেটাও বড় প্রশ্ন), মিডনাইট চিলড্রেন সহ আরও অনেক কালজয়ী লেখাও বেরিয়ে এসেছে তাঁর কলম থেকে। একজন সুস্থ্য মানুষ সাধারণত কারও সাথে কোন বিশেষ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করতে পারে, একজন মানুষের সমস্ত অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে না। তাই কিছু কিছু দ্বিমতের জন্য কারও পুরো সত্ত্বাটাই নাই করে দেওয়া অযৌক্তিক কারণ এভাবে চললে আমরা মানবজাতি তথা নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন করে তুলব।

দুবনা, ১৩ আগস্ট ২০২২ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা