শোক হোক শক্তি

 

বাংলাদেশ আজ জাতীয় শোক দিবস পালন করছে। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু এবার যে প্রশ্ন আমার মাথায় বার বার ঘুরছে তা হল জাতি কি আজ সত্যিই শোকাচ্ছন্ন? হলে জাতির কতটা এই শোক বহন করছে?

স্পষ্ট মনে পড়ছে ১৯৭৫ সালের এই দিনটির কথা। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। বাজারে দেখি সবাই গম্ভীর। এক অজানা আশঙ্কা সবার চোখে মুখে। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে এই মানুষগুলো ঘরবাড়ি সব হারিয়ে পালিয়ে জীবন কাটিয়েছে। কেউ ভারতে কেউ বা দেশে অন্য কোন গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ভরসা করে এরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করেছে। আবার কি সব নতুন করে শুরু করতে হবে? নাকি এবার চিরতরে বিদায় জানাতে হবে প্রিয় জন্মভূমিকে?

বাড়িতে সবাই আকাশবাণী আর বিবিসি ধরতে ব্যস্ত। ওরাই শেষ ভরসা সত্য জানার জন্য। বাংলাদেশ বেতার ইতিমধ্যে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে, জয় বাংলা হয়েছে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। যদিও শেখ মুজিবের হত্যার খবরে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত, হতবাক তবে ঢাকার এলিট শ্রেণীর একটা বিরাট অংশ মনে হয় খুশিই। রেডিও বাংলাদেশ থেকে খুশির খবর প্রচার করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় নাকি মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। জেনারেল ওসমানী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা একে একে শপথ গ্রহণ করছে। শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর খন্দকার মুশতাক প্রেসিডেন্ট সেজেছে। শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার প্রায় সবাই ক্ষমতা দখলকারী সেনাদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে নতুন মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছে।

এসব ভেবে মনে হয় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির এক বিরাট অংশের জন্য শোকের হলেও অনেকের জন্য সুখেরও হয়েছিল।

আজ আমরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার অবনতি দেখে প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি বর্তমান আওয়ামী লীগ আর শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নেই। আর সব দোষ দেই আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে তার আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশকে, তার ভোটের রাজনীতিকে। এটা ঠিক ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণ পুরুষ। পঁচাত্তরের ঘটনা প্রমাণ করে এই আওয়ামী লীগই জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে সাবোটাজ করেছে আর পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট তাঁকে হত্যাও করেছে এই আওয়ামী লীগ। তাই সমস্যা বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে নয়, সমস্যা আওয়ামী লীগে, আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্রে। যতক্ষণ না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ আর দেশের মানুষ সেটা বুঝবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের হাহুতাশ করেই দিন কাটাতে হবে।

আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ফিরিয়ে এনে তিনি যে জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করাই হবে এই শোককে শক্তিতে পরিণত করার অন্যতম প্রধান উপায়।

দুবনা, ১৫ আগস্ট ২০২২



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা