সম্প্রীতি না স্বজন প্রীতি

 

সমস্যা ততটা সত্য বলায় নয় যতটা কেন এ ধরণের কথা সত্য হয় তাতে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছেন। তিনি মুখ খুলে না বললেও দেশের অধিকাংশ মানুষ এটা বিশ্বাস করে। প্রশ্নটা সত্য মিথ্যার নয়, প্রশ্ন হল একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কেন অন্য রাষ্ট্রকে নিজের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে বলবে। এখানে মন্ত্রীর অপ্রিয় সত্য না বলার চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের রাজনীতিকে অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে যতদূর সম্ভব বের করে আনা। তবে এজন্যে শুধু সরকার নয় সব দলকেই সক্রিয় হতে হবে। আমাদের দেশে প্রায় সমস্ত বড় বড় দলই যে ক্ষমতায় আসার জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, ভারত, সৌদি আরব এসব দেশের দরগায় ধর্না দেয় সেটা কে না জানে।
প্রথম শ্রেণিতে পড়া এক শিশু বলেছে সে ক্রিকেটার সৌম্য সরকারের সাথে দেখা করতে চায় না কারণ সৌম্য হিন্দু। ছেলেটার দোষ নেই। হিন্দু বিদ্বেষ বা সঠিক ভাবে বললে ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই শিশু পরিবারে, স্কুলে, রাস্তাঘাটে যা দেখে বা শোনে সেটাই বলে। আশির দশকে মস্কোয় আমার এক ইয়ার মেট ছিল। প্রগতিশীল। তারপরেও কখনো সখনো জিজ্ঞেস করত "কিরে মালু কি খবর?" না তখন, না এখন কখনোই ওর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা নিয়ে আমার মনে কোন প্রশ্ন ছিল না। ও হয়তো ভাবতেই পারত না যে মালু কথাটা আমাকে কষ্ট দিতে পারে। অনেকেই মালাউন শব্দের অর্থ পর্যন্ত জানে না, হিন্দুর সিনোনেম মনে করে। কারণ ছোটবেলা থেকে এভাবেই তাদের শেখানো হয়েছে। এসব কথা, এসব ভাবনায় তারা অন্যায় কিছু দেখে না বা মনে করে না।
সমস্যা হল অনেকেই হয়ত ব্যক্তি সৌম্যকে অপছন্দ করে না। তাদের সমস্যা কেন একজন অমুসলিম ভালো খেলবে। দোষটা ভালো খেলার নয়। একজন অমুসলিম ভালো খেলার মানে সে অনেক মুসলমানের চেয়ে এই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। এখানেই সে আঘাত পায়। কারণ সে জন্ম থেকেই জেনে আসছে যে মুসলমানেরা অন্য যে কারও চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ফলে
এই সৌম্যই যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তবে তাকে নিয়ে কোন প্রশ্নই থাকবে না। এটা অনেকটা মোমেন খানের "পাকিস্তানের কবিরা কেন রবীন্দ্র সঙ্গীত লিখতে পারে না" এই প্রশ্নের মত। রবীন্দ্রনাথের রচনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তার সমস্যা নেই, সমস্যা রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমান নন।
কেন এমন হয়? এর কারণ দেশে অন্য ধর্ম সম্পর্কে প্রতিনিয়ত যা খুশি তাই বলা হচ্ছে কিন্তু তা যে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে সেটা না সরকার না জনগণ কেউ ভাবছেই না। এটাকেই তারা চরম সত্য হিসেবে মনে করে। আর সত্য যদি কাউকে আঘাত করে সে দোষ আর যার হোক তাদের নয়। এই যে ধর্মীয় শোভিনিজম সেটাই বার বার এসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণেই এসব ঘটছে। পাঠ্য পুস্তক থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রচনা সরানো, মিথ্যা মামলায় সংখ্যালঘু শিক্ষকদের জেলে পাঠানো এ সবই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি তাদের মনোভাব যে সঠিক সেটাই প্রতিষ্ঠিত করে। যারা এটা করে তারা গর্বের সাথেই এসব করে। তারা ধারনাও করতে পারে না যে এভাবে তারা শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবনকেই অসহনীয় করে তুলছে না, নিজেদেরকেও সামাজিক, নৈতিক ভাবে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে হিটলারের ডাকে জার্মানরা ইহুদীদের হত্যা করা, তাদের ঘরবারি লুট করা বীরত্ব মনে করত, কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরকে এ জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে, আজও দিচ্ছে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকার ও নাগরিক সমাজকে এক সাথে কাজ করতে হবে। যেসব লোকজন মিথ্যা আইডি খুলে সংখ্যালঘুদের নামে ইসলামের অবমাননা করে তাদের উপর আক্রমণ চালায় সেই সব লোকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে, জন সমাবেশে, স্কুল কলেজে যারা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে আর ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। একাত্তরের চেতনা বিরোধী গোষ্ঠীর কাছে নিজেদের আদর্শ বন্ধক রেখে আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে গঠন করা যায় না।
দুবনা, ২০ আগস্ট ২০২২



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা