অভিজ্ঞতা


এবার পূজায় বেশ কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। প্রথমত এবারই প্রথম পূজার উপর লাইভ করলাম। বেশ কিছুদিন হল জ্বলদর্চি পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখি। হঠাৎ পত্রিকার সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী বললেন মস্কো পূজার উপর কিছু লিখতে। কথা দিলাম না, তবে মাথায় রাখলাম। লিখতে গিয়ে দেখি অনেক তথ্যই জানি না। শুধু আমি নই, কেউই না। মানে কেউ ঠিক করে বলতে পারল না মস্কোয় পূজা ১৯৮৯ সালে শুরু হয়েছে নাকি ১৯৯০। আমি ১৯৮৯ সালে জুলাই থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে ছিলাম, সেবারই দেশে শেষ পূজা দেখি। মনে হয়েছিল এসে বন্ধুদের অনেকের কাছেই মস্কোর পূজার কথা শুনেছিলাম, আফসোস করেছিলাম এমন একটা ইভেন্ট মিস করলাম বলে। তবে যখন অন্যদের সাথে কথা বললাম, প্রায় সবাই বলল পূজার শুরু ১৯৯০ সালে। যদিও কেউ কেউ ১৯৮৮ আর ১৯৮৯ সালের কথাও বলেছিল। সে যাই হোক। শেষ পর্যন্ত মনে একটু সন্দেহ রেখেই মস্কোর পূজার উপর লিখলাম। এরপর ঋত্বিক বাবু অনুরোধ করলেন লাইভ পূজা দেখাতে। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমি বরাবরই ফটোগ্রাফি করি, ভিডিও তেমন করতাম না। অনেক আগে এই ঋত্বিক বাবুর অনুরোধেই প্রথম ভিডিও করা, দুবনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য জ্বলদর্চি পত্রিকার পাঠক ও দর্শকদের কাছে তুলে ধরার জন্য। এরপর তো সময় পেলেই ভিডিও করি। যাহোক, অনেক রকম প্ল্যান নিয়ে এগুচ্ছি এর মধ্যে শুনলাম পূজা গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারক্লাবে হবে না। হবে এক বাসায়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। প্রোগ্রাম ঘোষণা হয়ে গেছে। তখন প্রথমে ভাবলাম নভ দেভিচি মনাস্তিরের ওখান থেকে লাইভ করি। পরে মনে হল ভাল হবে রেড স্কয়ার থেকে করলে। শেষ পর্যন্ত চলে গেলাম আরবাতে – কেননা জায়গাটায় সমসময়ই মেলা মেলা ভাব। তাছাড়া ওটা কখনই বন্ধ করে না। তাই সেখান থেকেই লাইভ করলাম। অনেকেই পূজার মন্ডপ আর প্রতিমা দেখতে চাইছিলেন। দেখাতে পারিনি। এটা ছিল রবিবার, সপ্তমীর দিন। রাতে বাসায় ফিরে ফেসবুকে পূজার ছবি দেখলাম। মনে হল বাসাটা খুব ছোট নয়। যাহোক, প্রণবকে ফোন করে জানলাম পূজা হচ্ছে পার্ক প্যালেসে। তার মানে যাওয়ার চেষ্টা করা যায়। রিঙ্কুর সাথে যোগাযোগ করলাম। সোমবার ক্লাস শেষে চলে গেলাম পূজার প্যান্ডেলে। গেলাম অতি পরিচিত রাস্তা নিয়ে, আমাদের এক সময়ের বাসায় পাশ দিয়ে। কত কথাই না মনে পড়ে গেল। সেখানে এসে শুনলাম, পূজার স্থান পরিবর্তন যতটা না করোনা পরিস্থিতি তার চেয়ে বেশি যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে জড়িত। ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ যারা পূজার আসবেন তাদের পাসপোর্ট, টেলিফোন সহ বিভিন্ন ডাটা আগে থেকেই চাইছিলেন। তাই পূজা সরিয়ে আনা।
অনেকের সাথে দেখা হল। কথা হল অনেক আর তার চেয়েও বেশি কথা কাটাকাটি হল। বিশ্বাস নিয়ে, অবিশ্বাস নিয়ে। যুদ্ধ শুরু হল যুদ্ধ নিয়ে। আমার চেষ্টা ছিল যথা সম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া, কেননা আমি ওখানে গেছি পূজা দেখার জন্য, বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময়ের জন্য। গত দু দিন সেই বিতর্কের কিছু কথা লিখেছি। এখানে, কারণ ওখানে তর্ক করে অন্যদের পূজার আনন্দ মাটির করা ঠিক হবে বলে মনে করিনি।
এক জন কথা বলছিল খাবার নিয়ে।
- জান, আমি মাংস ছাড়া একেবারে থাকতে পারি না। অথচ এখন মাংস খাচ্ছি না।
তারপর মাংসের এক বিশাল ফর্দ উপস্থিত করল। সমস্যা হল এই যে এখানে কথাটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তবে তার চেয়েও যেটা বড় তা হল আমাদের মনোভাব – গরু শুয়োর এসব খাই বলেই যদি আমি নিজেকে পরমতসহিষ্ণু, ধর্মনিরপেক্ষ ইত্যাদি ইত্যাদি মনে করি তাহলেই সমস্যা। বলাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক – এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? আমরা সবকিছুর বাহ্যিক দিকটাই বেশি করে দেখি। ধর্ম বা যে কোন আদর্শের মর্মবাণীর চেয়ে তার বাহ্যিক দিকটা আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রুশরা বলে বোকাকে প্রার্থনা করতে শেখালে সে ঈশ্বরের কৃপা পাবার আশায় দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মাথা ভেঙে ফেলবে। বাংলার এক বিখ্যাত লেখক, নামটা এখন মনে নেই, বলেছিলেন, চারিদিক থেকে অভিযোগ অনুযোগ শুনতে শুনতে ঈশ্বর একসময় নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঈশ্বর যদি থেকেই থাকেন তাহলে এই অতি উৎসাহী বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের যন্ত্রণায় তিনি অনেক আগেই লোটা কম্বল নিয়ে প্যারালেল ইউনিভার্সে পালিয়ে গেছেন।

দুবনা, ০৬ অক্টোবর ২০২২



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা