সেই সময় এই সময়

প্রতি বছর আমাদের এখানে ইজিপ্ট, সাউথ আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা আসে তিন সপ্তাহের একটা কোর্সে। অনেকেই আমাকে ওদের সুপারভাইজার হিসেবে বেছে নেয়। এর আগে কাজ করেছি রোমানিয়া আর ইজিপ্টের ছাত্রদের সাথে। মাঝে করোনার কারণে অকারণে বন্ধ ছিল এই প্রোগ্রাম। এবার আবার শুরু হল। ইজিপ্টের তিন জন আমার সাথে কাজ করবে বলে জানিয়েছিল। গতকাল ওদের রিসিভ করতে গিয়ে দেখি শেষ মুহূর্তে একজন আসেনি। এবং সেই একজন ছিল এক ছাত্রী। আগে জানতাম না।

এতদিন পর্যন্ত যাদের সাথে কাজ করেছি সবার বয়স ছিল কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। কেউ বা সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ারের, কেউ বা সবে শেষ করেছে।

এবারের দুজন বেশ বয়স্ক। তিরিশের কোঠায় মনে হয়। ইতিমধ্যেই কাজে যোগ দিয়েছে।

আহমেদ আর মনসুর ওদের নাম। মনসুর অবশ্য আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল, লিখেছিল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর কাজ করছে। যেহেতু আমার কাজ কসমোলজির উপর তাই ওকে বললাম অন্য অপশন দেখতে। পরে ঠিক হল আমরা একে অন্যের কাছে শিখব। আহমেদ কোন যোগাযোগ করেনি। জিজ্ঞেস করলাম কি করতে চায়।
জয়েন্ট পাবলিকেশন। ওর কথা শুনে আমার ১৯৯৬ সালের এক ঘটনা মনে পড়ল। ট্রিয়েস্টে গেছি দু মাসের জন্য। বাংলাদেশের তিন জন সবে মাত্র কাজে যোগ দেওয়া শিক্ষক সেখানে। একজন খুব করে চাইল জয়েন্ট পেপার করতে কিন্তু কাজ করতে বলায় কেটে পড়ল। আমি তো অবাক। তবে একে দেখে সেরকম মনে হল না। 

তা বুঝলাম। কিন্তু দুই তিন সপ্তাহে তো এসব হয় না।
আমরা তো শুরু করতে পারি।
সেটা পারি।
আমি এপ্লাইড ম্যাথে পিএইচডি শেষ করেছি। আপনার সাথে পোস্ট ডক করতে চাই।
এগুলো আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার। সব কাগজপত্র রেডি হোক তারপর দেখা যাবে।

অফিসে এসে ওদের প্রোগ্রাম সম্পর্কে বললাম। মনসুর বলল আহমেদ ইলেক্ট্রোডাইনামিক্সের উপর কাজ করতে চায়।
এই বিষয়ে আমি শেষ পেপার লিখেছি ২০০০ সালে।
আমি দেখেছি ঐ পেপার। আমি দেশে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বোমার উপর কাজ করেছি।
আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। এসব করি না। তবে দেখি কোন নক্ষত্রের উপর কিছু করা যায় কি না।

ওদের সাথে কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ওরা প কে ব বলে। যেমন কথায় কথায় আমাকে ব্রো (ঠিক ব্রো নয় ঐ রকম কিছু একটা) বলছিল। ওরা চলে গেলে বুঝলাম ওটা ছিল প্রফেসরের আরবি ভার্সন।

এখানে গুড মর্নিং কিভাবে বলে।
দব্রোয়ে উৎরো।
আর এমনি সম্বোধন করতে?
প্রিভিয়েত।
ব্রিভিয়েত! আমরা বলি মারহাবা।
জানি।
তাই?
আমি প্যাট্রিস লুমুম্বায় পড়াশুনা করেছি। অনেক আরব ছেলেমেয়ে ছিল আমাদের সাথে। ওরা প কে ব বলত। চল বিয়ার খেতে যাই রুশে বলে পাইদিয়ম পাপিয়ম পিভা। ওরা বলত বাইদিয়ম বাবিয়ম বিভা।

অনেকক্ষণ ধরে হো হো করে হাসলাম। হাসির ভেতরে ভেসে উঠল অনেক আরব মুখ। আচ্ছা কেমন আছে ওরা? ওরাও কি ইউক্রেন রাশিয়া প্রশ্নে আমাদের বাঙালিদের মতই দ্বিধাবিভক্ত? 

আজ অফিসে এসে দেখি ওরা অপেক্ষা করছে। বছর তিনেক আগে একটা পেপার লিখেছিলাম। ভুলেই গেছিলাম। ওরা সেটা খুঁজে বের করে এনেছে ওর উপর কাজ করবে বলে। আমি মনে মনে বলি - এরা তো দেখছি ফেসবুক। কবে কি করেছি সেটা নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমার মত অলস লোককে চাঙ্গা করার জন্য এরকম লোকের দরকার আছে। আশা করি সামনের দিনগুলো ওদের সাথে ভালই কাটবে। 

ও হ্যাঁ, ওদের বললাম, আজ থেকে ২৯ বছর আগে ঠিক এই দিনে আমি দুবনায় কাজ শুরু করেছিলাম। 

দুবনা, ১৮ মে ২০২৩ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা